মৃদু বাতাসে ঘরের আঙিনার গাছে মরিচের নাচন। পাশের মাচায় লকলকিয়ে বাড়ছে বরবটি, নিচের গাছে ঝুলছে ছোট ছোট সবুজ বেগুন। এক কোণে লালশাকও মাটি ফুঁড়ে উঠেছে ইঞ্চি দুয়েক। এর পাশেই সুবাস ছড়াচ্ছে গাছের রঙিন ফুল। এককথায় ছোট পরিসরে আদর্শ ছিমছাম ঘর। আর সেই সুখনিলয়ের উঠানে বসে আড়াই বছরের ছেলে পার্থকে ভাত মাখিয়ে পরম যত্নে মুখে তুলে দিচ্ছিলেন রত্না দাস। খুলনার ডুমুরিয়ায় ভূমিহীনদের জন্য সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ পাওয়া ছিন্নমূলদের মধ্যে তিনিও একজন। গত জানুয়ারিতে এই ঘরে পরিবার নিয়ে ওঠেন রত্না। এখন কেমন আছেন জানতে চাইলে হাসিমুখে রত্না দাস বললেন, ‘বৈশাখ মাসে ঝড়-বাদলে পাহির বাসা যেভাবে ভাঙ্গে হেরম ছিল আমাদের থাহার খুপরি ঘর। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ঘর-জমি দিছে, ঘর নিয়ে আর টেনশন নাই। দুঃখের দিন মোটামুটি শেষ, নিজেও ভালো একটা কাজের চেষ্টা করতাছি।’
পাশেই ভ্যানচালক আলিম আলীর ঘর। এমন ঘরে থাকার অনুভূতি জানতে চাইলে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন আলিম আলী। কিছু সময় চুপ থাকার পর বলে উঠলেন, ‘আগে চাকুন্দিয়ায় পরের জায়গায় তাঁবু বানাইয়া থাকতাম। তিন পোলা-মাইয়া ও বউরে নিয়া থাকতে খুব কষ্ট হইত। গেল চার মাস ধইরা অনেক ভালো আছি। এখন আর বৃষ্টিতে ভিজতে হয় না, রোদেও পুড়তে হয় না। আরামে ঘুমাইতে পারি। বলা যায় ঘর পাওয়ার পর যে সুখ পাচ্ছি, দুনিয়াতে এর চেয়ে সুখ আর কিছুতে পাইনি। আমাদের মতো ঠিকানা ছাড়া মানুষদের ঘর করি দিয়ার জন্য আল্লাহ শেখ হাসিনা সরকারকে ভালো রাখুক।’
অন্যদিকে গোপালগঞ্জ সদরের হরিদাসপুর ইউনিয়নে দিনমজুর মফিজুল মিয়া ঘর পাওয়ার আনন্দ প্রকাশ করেন এভাবে, ‘আগে থাকার নির্দিষ্ট জায়গা না থাহায় কত যে কষ্ট করছি। শেখ হাসিনা সরকার আমাদের জন্য যা করছে, কিভাবে যে ধন্যবাদ দিব ভাষা নাই। তবে কথা একটাই, আল্লাহ তারে ভালো রাখুক, আয়াত বাড়াইয়া দিক।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মাধ্যমে মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে খুলনার ডুমুরিয়ার কাঁঠালতলা বাজার সংলগ্ন এলাকায় ৬০টি এবং গোপালগঞ্জের বেড়াখাল নদীর তীরে মালেঙ্গা গ্রামের খেয়াঘাট এলাকার হরিদাসপুর ইউনিয়নে ৩৬টি ও উলপুর ইউনিয়নে ৪০টি নতুন ঘর দেওয়া হয়েছে ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল পরিবারকে। এসব আশ্রয়ণ প্রকল্পে আরো নতুন ঘরের কাজ চলছে। সরেজমিন ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার পেয়ে কষ্টের দিনকে ছাইচাপা দিয়ে এভাবেই সুখ খুঁজতে বিভোর রত্না, আলিম ও মফিজুলের মতো অনেকেই। জমিসহ ঘর পেয়ে জীবনমান উন্নয়ন করতে সরকারি উদ্যোগে কবুতর, হাঁস, ছাগল ও গরু পালন করছেন তাঁরা। পাশাপাশি ঘরের পাশে লাগিয়েছেন রকমারি সবজি। কেউ কেউ পেশা বদলিয়ে বাঁশের, বেতের কাজ, নারীদের কেউ দরজির কাজ এবং পুরুষরা হকারি করতে বাইরে বের হয়েছেন। গত জানুয়ারি থেকে ঘর পাওয়ার পর এভাবেই তাঁদের জীবনের গল্প অনেকটা বদলে গেছে।
ডুমুরিয়া আশ্রয়ণের বাসিন্দা তৃষা শিকদার জানালেন, নিজে করেন দরজির কাজ, স্বামী শ্রমিক। কষ্ট করে মেয়ে সুমা দাসকে মাগুরা সরকারি কলেজে মাস্টার্সে পড়াচ্ছেন। মেয়ে থাকেন মামার বাড়িতে। এখন মনে হচ্ছে ঘর পেয়ে আগের চেয়ে অনেক ভালো পরিবেশে আছেন। শিগগিরই মেয়েকে নিয়ে আসবেন। তাঁর পাশের ঘরের বৃদ্ধা রওশনা বেগম বলেন, ‘জীবনের শেষ সময় নির্দিষ্ট ঠিকানা পাইলাম। এখন এক ওয়াক্ত না খাইলে সুখে থাকুম। চারপাশের মানুষও খুব বালা পাইছি। দোয়া করি, শেখ হাসিনা যত দিন বাইচ্ছা থাহে, তত দিন যাতে প্রধানমন্ত্রী থাহে।’
এসব প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি ঘরে মিলেমিশে আছে। দিন যতই যাচ্ছে একে অপরের সুখ-দুঃখের সঙ্গীও হচ্ছে। ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পে বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোনো ধর্মীয় পরিচয় নয়, শুধু ভূমিহীন ও গৃহহীন কি না সেটাই দেখা হয়েছে। যাঁরা ঘর পেয়েছেন তাঁদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য সরকারিভাবে বিভিন্ন সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা, কেউ আর গৃহহীন থাকবে না। যাঁদের ঘর নেই, জমি নেই, তাঁরা সবাই ঘর পাচ্ছেন। সরকারের নির্দেশে গৃহহীন যাঁরা এখনো তালিকায় আসেননি, তাঁদের খুঁজে খুঁজে তালিকা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে যাঁরা ঘর পেয়েছেন, তাঁদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজে যুক্ত করা হচ্ছে। প্রতিটি ঘর নির্মাণে প্রথম পর্যায়ে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা করে ব্যয় হয়েছে। পরে সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের দাম বিবেচনায় এ বছর প্রতিটি ঘর নির্মাণে দুই লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। সব মিলিয়ে এই পর্যায়ে প্রকল্প ব্যয় প্রায় দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যার পুরোটাই সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে আসছে।’
গত ২৩ জানুয়ারি মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে দেশের গৃহহীনদের জমি ও ঘর দেওয়ার কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন ৬৬ হাজার ১৮৯টি ঘর দেওয়া হয়। সব পরিবারকে ২ শতাংশ খাসজমির মালিকানা দিয়ে সেখানে আধাপাকা ঘর করে দেওয়া হয়েছে। একই দিনে ২১ জেলার ৩৬ উপজেলায় ৭৪৩টি ব্যারাকে তিন হাজার ৭১৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। এ ছাড়া আগামী ২০ জুন দ্বিতীয় ধাপে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের মাঝে আরো ৫৩ হাজার ৩৪০টি ঘর হস্তান্তর করা হবে। সমতলের গৃহহীনরা নতুন ঘরে আসবাব স্থানান্তরের জন্য পাঁচ হাজার এবং হাওরাঞ্চলের গৃহহীনরা পাবেন সাত হাজার টাকা।