টিকা: চীনের সঙ্গে ‘ভুল-বোঝাবুঝির অবসান’

Shakil Shahriar
জুন ৭, ২০২১ ৫:২০ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

টিকা নিয়ে চীনের সঙ্গে যে ঝামেলা হয়েছিল, সে ঝামেলার মীমাংসা হয়েছে। তারাও একটু দুঃখ প্রকাশ করেছে। শুরুর দিকে তারাও তো একটা ঝামেলা করেছিল। আমরাও ভুল করেছি: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
দাম জানিয়ে দেয়ার কারণে চীন উদ্ভাবিত সিনোফার্মের টিকা প্রাপ্তি নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, তা কেটে গেছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
নিউজবাংলাকে তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ দুঃখ প্রকাশ করে চিঠি দেয়ার পর ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হয়েছে। বাংলাদেশ ১০ ডলারেই টিকা পাবে বলে আশা করছেন তিনি।
চীন সরকারের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া না গেলেও ঢাকায় দেশটির দূতাবাসের উপকমিশনার হাওলাং ইয়ান নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ টিকা পাবে।
চীনের সঙ্গে টিকা আলোচনা যেভাবে
অক্সফোর্ড উদ্ভাবিত করোনার টিকার জন্য নির্ভর করেছিল ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের ওপর। সেখান থেকে ৩ কোটি ৪০ লাখ টিকা কেনার চু্ক্তি হয়েছিল। এর বাইরে বিশ্বজুড়ে ন্যায্যতার সঙ্গে টিকা বিতরণে গড়ে ওঠা জোট কোভ্যাক্স থেকে পাওয়ার কথা ছিল আরও সাত কোটির বেশি টিকা।
কিন্তু কোভ্যাক্স কোনো টিকা দেয়নি। সিরাম থেকে ৭০ লাখ পাওয়ার পর আর কোনো টিকা আসেনি। আর সে দেশ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া গিয়েছিল আরও ৩৩ লাখ টিকা।
এই এক কোটি তিন লাখ টিকার সবই প্রায় শেষ। আর টিকাস্বল্পতায় প্রথম ধাপে যে ৬২ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছিল, তাদের সবাইকে দ্বিতীয় ডোজ দেয়া যায়নি।
সিরাম থেকে টিকা প্রাপ্তির অনিশ্চয়তার মধ্যে সরকার চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা নিয়ে আসার যে চেষ্টা করে। টিকা আমদানির পাশাপাশি দেশে উৎপাদন নিয়েও চেষ্টা চলছে।
যে কারণে অচলাবস্থা
চীনের টিকা কেনার প্রস্তুতি যখন এগিয়ে চলেছে, তখন এই বিষয়টিতে অনিশ্চয়তা চলে আসে এক সরকারি কর্মকর্তার কারণে।
চীনের সিনোফার্মের দেড় কোটি টিকা আনতে চায় সরকার। ২৭ মে চীনের কাছ থেকে দেড় কোটি টিকা কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেয় ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে চার ডলারে টিকা কেনার চুক্তি হওয়ার পর এই টিকার দাম বেশি হয়েছে কি না, এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছে বাংলাদেশে। সরকারবিরোধীদের দাবি, অন্যান্য দেশ যে টাকায় টিকা কিনছে, বাংলাদেশ দিয়েছে এর চেয়ে বেশি।
চীনের কাছ থেকে টিকা কেনার আলোচনার সময় দাম কত হবে, এ বিষয়ে কোনো কিছুই বলা হচ্ছিল না।
তবে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর এই বিষয়টি নিয়ে তথ্য পাওয়া যায়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. শাহিদা আকতার বলেন, ‘চীন থেকে প্রতি চালানে ৫০ লাখ করে তিন ধাপে দেড় কোটি ডোজ করোনার টিকা কেনার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক ডোজ টিকা ১০ ডলার ধরে হিসাব করলে দেড় কোটি ডোজ আনতে সরকারের খরচ হবে ১ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এ টিকা কেনা হবে।’
চুক্তি হওয়ার আগেই দাম গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়ে পড়ায় তৈরি হয় জটিলতা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার খুরশীদ আলম বলেন, ‘তারা (চীন) বারবার বলেছিল এই দাম কারো কাছে না বলতে। দাম প্রকাশের পর ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কিছু দেশ চীনের কাছ থেকে বেশি দামে টিকা নিতে আপত্তি জানিয়েছে। টিকার দামের বিষয়টি নন-ডিসক্লোজেবল ছিল। সাংবাদিকরা কীভাবে কীভাবে বের করে ফেলেছেন। এখন তারা (চীন) আমাদের চাপাচাপি করছে। চীন আমাদের লো-প্রাইসে (কম দামে) টিকা দিচ্ছে, তবে দাম প্রকাশ হওয়ার পর জটিলতা বাড়ছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, টিকার দাম গণমাধ্যমে আসার কারণে চুক্তি অনুযায়ী ১০ ডলারে টিকা পাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেয়া দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বেইজিংকে এ বিষয়ে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে বেইজিংয়ের কাছে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে টিকার দাম প্রকাশ করা হয়নি বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
পাশাপাশি টিকার দাম জনসমক্ষে প্রকাশ করার কারণে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শাহিদা আকতারকে তার পদ থেকে সরিয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ভয়েজ অব আমেরিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই তথ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কিছু দেশও একই দামে টিকা চাইছে। তাদের সঙ্গে ১৫ ডলারে টিকা দেয়ার আলোচনা চলছিল।
যা বলছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বাংলাদেশ দুঃখ প্রকাশ করে চিঠি পাঠানোর পর চীনের অবস্থান কী- এ বিষয়ে জানতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে কথা বলে নিউজবাংলা।
তিনি বলেন, ‘টিকা নিয়ে চীনের সঙ্গে যে ঝামেলা হয়েছিল, সে ঝামেলার মীমাংসা হয়েছে। তারাও একটু দুঃখ প্রকাশ করেছে। শুরুর দিকে তারাও তো একটা ঝামেলা করেছিল। আমরাও ভুল করেছি।’
তাহলে বাংলাদেশ কী মূল্যে টিকা পাচ্ছে, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ইনশা আল্লাহ আশা করা যায় ১০ ডলারে টিকা আমরা পাব।’
চীন দূতাবাসের যে বক্তব্য
এই বিষয়টি নিয়ে এখনও চীন সরকার আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য দেয়নি।
তবে শনিবার ঢাকায় চীন দূতাবাসের উপকমিশনার হাওলাং ইয়ান ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেন, যাতে তিনি নানা প্রসঙ্গ টানেন।
চীন দ্বিতীয় ধাপে উপহার হিসেবে যে ছয় লাখ টিকা বাংলাদেশকে দিতে যাচ্ছে, তা ১৩ জুনের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছবে বলে নিশ্চিত করেন তিনি। এর আগে দেশটি উপহার দিয়েছিল পাঁচ লাখ টিকা।
ইংরেজিতে দেয়া পোস্টে চীনের কর্মকর্তা লেখেন, ‘চীন সরকারের উপহারের ছয় লাখ টিকা বাংলাদেশকে ১৩ জুনের মধ্যে পৌঁছে দিতে প্রস্তুতি চলছে।’
অন্য আরেকটি পোস্টে ‘বাংলাদেশের ওপর চীন ক্ষুব্ধ’ বলে ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদন শেয়ার দিয়ে তিনি এই কূটনীতিক লেখেন, ‘ভাবছি, গণমাধ্যমের এই তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে বলতে হবে বাংলাদেশের দিক থেকে সব সময় কেন ভুল তথ্য দেয়া হচ্ছে।’
তিনি লেখেন, ‘সত্য বলতে প্রথমত, সিনোফার্ম ও বাংলাদেশের পক্ষে মধ্যে আজ অবধি কোনো চুক্তি হয়নি। দ্বিতীয়ত, যা হয়েছে তা ছিল বাংলাদেশ সরকার ও চীনা সরকারের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে সিনোফার্মের টিকা উৎপাদনের আলোচনা।’
তিনি এও লেখেন যে, ‘শুধু এটুকু বলতে পারি, আমরা আন্তরিকভাবে আশাবাদী যে আমাদের বাংলাদেশি ভাইবোনেরা সঠিক সময়ে সর্বাধিক প্রয়োজনীয় টিকা পাবেন।’