কঠোর বিধিনিষেধের জীবনযাপন শুরু হচ্ছে আজ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেকে এবং অন্যকে সুরক্ষিত রাখার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি বা অন্য যেকোনো পেশাগত কাজ এক পাশে সরিয়ে রেখে আপাতত ৮ দিন ১৩ দফা নির্দেশনা মেনে ঘরবন্দি জীবনযাপন করতে হবে। ধাপে ধাপে এই বন্দিজীবন কত দিনে গড়াবে তা জানে না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও। কিন্তু মানুষকে ঘরে আটকে রাখার জন্য যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সেসব সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারছে না সরকার। এতে নানা ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে।
গত রবিবার ব্যবসায়ীদের একাধিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সেখানে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক খোলা রাখার কথা বলেছিলেন। তারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানিয়েছিলেন যদি কলকারখানা খোলা থাকে, তাহলে ব্যাংকও খোলা রাখতে হবে। কলকারখানা খোলা থাকলে আর ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলে ব্যবসায়ীদের খুব একটা লাভ হবে না। ব্যবসায়ীদের এই বক্তব্য শোনার পরও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যে নির্দেশনা জারি করেছে সেখানে কলকারখানা খোলা রেখেছে ঠিকই, কিন্তু ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা পাওয়ার পর গত সোমবার বৈঠকে বসেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তারাও নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংক বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত দেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও অর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদের এ নির্দেশনা পেয়ে আমরা অবাক হয়েছি। পোশাক কারখানা চালু থাকলে ঋণপত্র খোলাসহ অন্য কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। না হলে কারখানা চলবে না। এটা একটা স্বাভাবিক হিসাব। এটাও কেন বুঝতে পারল না মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।’
ব্যাংক বন্ধ রাখাসহ ১৩ দফা নির্দেশনা দিয়ে গত সোমবার আদেশ জারি করার দিনই ব্যাংকে দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। পরদিন অর্থাৎ গতকাল মঙ্গলবার এই দীর্ঘ সারি ব্যাংকের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে অনেক দূর পর্যন্ত। শুধু সাধারণ আমানতকারীই নয়, শেষ দিনে কাজ শেষ করার জন্য বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও ব্যাংকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন। এই অবস্থা দেখে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ব্যাংকসংক্রান্ত তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হয়। গতকালই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বিশেষ প্রয়োজনে ব্যাংক সেবা প্রদানের অনুরোধ জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দেয়। ওই চিঠি পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে গত সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছিল, ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংকের সব শাখা বন্ধ থাকবে। তবে বন্দর এলাকার ব্যাংক শাখা খোলা থাকবে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার গতকাল রাতে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্তে পরিপক্বতার ছাপ নেই। ভারতের রাজধানীতে আমাদের রাজধানীর চেয়ে অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত। দিল্লিতে মানুষ মারাও যাচ্ছে বেশি। তারা কিন্তু ব্যাংক বন্ধ করেনি। ইউরোপের অনেক দেশ করোনার প্রথম ঢেউয়ে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছিল। আমেরিকার নিউইয়র্কও তাই। ব্রাজিলে প্রতি মিনিটে ২ জন করে মানুষ মারা গেছে। কই, কোথাও তো ব্যাংক বন্ধ করা হয়নি। কোনো ব্যক্তি কভিড আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য তার টাকা লাগবে। করোনা আক্রান্ত ওই ব্যক্তিটি কোথায় টাকা পাবে? মানুষ তো ব্যাংকে টাকা রাখে বিপদের দিনের জন্য। ব্যাংক বন্ধ থাকলে কীভাবে ওই লোকটি টাকা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাবে? ধরলাম কভিডের চিকিৎসার জন্য ২ লাখ টাকা দরকার। কোনো মানুষ কি ঘরে দুই লাখ টাকা নিয়ে বসে থাকে? বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কথাই ধরি। দিনের লেনদেনের টাকা তারা কোথায় রাখবে? কোটি কোটি টাকা নিয়ে হাসপাতালগুলো কয়দিন বসে থাকবে। কাজেই এই সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। ব্যাংকের মতো এসেনশিয়াল সার্ভিস বন্ধ করা যায় না।’
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘সরকারকে আরও ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। হুটহাট যেন সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়। দ্রুত সিদ্ধান্ত বদলাতে গেলে মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এর আগে বাস চলবে না বলা হলেও তা বাহাল রাখতে পারেনি সরকার। মার্কেট খোলা রাখার জায়গায়ও সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হয়। কাজেই আরও ভেবেচিন্তে, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে গণমানুষের কথা চিন্তা করতে হবে।’
১৩ দফা বিধিনিষেধ ঘোষণার পর তা কার্যকর করার জন্য সরকারের উদ্যোগ কী জানতে চাওয়া হলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, করোনাভাইরাসজনিত রোগ কভিড-১৯ এর বিস্তার রোধ করার জন্য যে বিধিনিষেধ ঘোষণা করা হয়েছে সেখানেই কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তার ইঙ্গিত রয়েছে। জেলা ও মাঠ প্রশাসন এবং পুলিশ এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে। স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক তার পক্ষে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান করবেন। মূলত জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে। ইতিমধ্যে জেলায় জেলায় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া পুলিশও এই নির্দেশনা কঠোরভাবে মানানোর জন্য মাঠে থাকবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগও পুরো বিষয়টা তদারকি করছে।
বিধিনিষেধের ৮ দিনের মধ্যে যাদের খুব জরুরি কাজে বাইরে যাওয়া প্রয়োজন হবে তাদের জন্য মুভমেন্ট পাসের ব্যবস্থা করছে পুলিশ। অনলাইনে অ্যাপসের মাধ্যমে মুভমেন্ট পাসের জন্য আবেদন করতে হবে। কিন্তু সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে কীভাবে এই আবেদন করা সম্ভব গতকাল পর্যন্ত তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। গতকাল এসংক্রান্ত একটি অ্যাপস উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের পর থেকেই আবেদনের হিড়িক পড়ে। সন্ধ্যা পর্যন্ত মুভমেন্ট পাসের আবেদন জমা পড়েছে ৬০ হাজার। এর মধ্যে ৩০ হাজার আবেদন ইস্যু করেছে পুলিশ।
বিধিনিষেধের আগের দিন গতকাল রাজধানীর বাজারগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। বিধিনিষেধের শুরুর দিন রোজাও শুরু হচ্ছে। একদিকে বিধিনিষেধ অন্য দিকে রোজাএ দুই কারণে বাড়তি কেনাকাটা করতে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ও দোকানে ভিড় করছেন ক্রেতারা। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, রোজার আগে কিছু পণ্যের বিক্রি বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। তবে বিধিনিষেধ যোগ হওয়ায় গতকাল থেকে ক্রেতাদের ভিড় বেশি। অনেকে আতঙ্কে বাড়তি পণ্য কিনছেন।
বিধিনিষেধে আগে থেকেই দূরপাল্লার বাস বন্ধ রয়েছে। এ কারণে গতকাল শেষ দিনে অফিস করেই অনেককে রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে ছুটতে দেখা গেছে। করোনা পরিস্থিতিতে চলমান বিধিনিষেধে দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, সিএনজিসহ নানা মাধ্যমে পাটুরিয়া ও আরিচাঘাট হয়ে মানুষ গ্রামের বাড়ি ফিরছেন। অনেকে মোটরসাইকেল, পিকআপ ও ট্রাকে করে বাড়ি ফিরেছেন। যাত্রীদের মধ্যে ছোট শিশু ও পরিবারসহ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। অবৈধভাবে দূরপাল্লার রুটে যাত্রী বহনকারী অনেক পরিবহন আটকে ট্রাফিক পুলিশকে মামলা দায়ের ও জরিমানা আদায় করতে দেখা গেছে। সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মাইক্রোবাস অথবা প্রাইভেটকার থামলেই যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। এ সময় অতিরিক্ত ভাড়ার লোভে স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে গাড়িভর্তি করে মানুষ নিয়ে ছুটে যাচ্ছে পরিবহনগুলো।
ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আটকাতে ৮ দিনের জন্য যে ১৩ দফা বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে সরকার, তা চলবে ২১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত। এসব নির্দেশনার আলোকেই আজ বুধবার থেকে সব ধরনের অফিস ও পরিবহন বন্ধ থাকবে। আজ ভোর ৬টা থেকে লকডাউনের মধ্যে শপিংমল বন্ধ থাকবে। কাঁচাবাজারে কেনাবেচা হবে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। হোটেল-রেস্তোরাঁ দিনে ৭ ঘণ্টা, রাতে ৬ ঘণ্টা খোলা শুধু খাবার বিক্রি ও সরবরাহ করতে পারবে। এই সময় অতি জরুরি দরকার ছাড়া ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে টিকা কার্ড দেখিয়ে টিকা নিতে যাওয়া যাবে।
এই সময় সব সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস বন্ধ রাখতে বলা হলেও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে শিল্পকারখানা চালু রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
শিল্পকারখানা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে। তবে শ্রমিকদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আনা-নেওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা যেমনকৃষি উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, কভিড-১৯ টিকা প্রদান, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস-জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, স্থলবন্দর, নদীবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাক সেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিস, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এ নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে।
অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন বা সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। তবে টিকা কার্ড দেখিয়ে টিকা নেওয়ার জন্য যাতায়াত করা যাবে।
খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা এবং রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কেবল খাবার বিক্রি বা সরবরাহ (কিনে নিয়ে যাওয়া/অনলাইন) করা যাবে। শপিংমলসহ অন্যান্য দোকান বন্ধ থাকবে।
কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাবেচা করা যাবে। বাজার কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
বোরো ধান কাটার জরুরি প্রয়োজনে কৃষিশ্রমিক পরিবহনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন সমন্বয় করবে।
গত বছরের মার্চ মাসে দেশে কভিড রোগী শনাক্ত হলে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সেই ছুটি ধাপে ধাপে বাড়িয়ে ৬৬ দিন পর অফিস খোলা হয়।