টিকা নিতে দীর্ঘ হচ্ছে আগ্রহীদের তালিকা। বয়সসীমা কমিয়ে আনার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে নিবন্ধন ও টিকাগ্রহীতার সংখ্যা। গতকাল পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ। গত ২৪ ঘণ্টায় নিবন্ধন করেছেন ২ লাখ ৩৯ হাজার ৫২২ জন। তবে তাৎক্ষণিক নিবন্ধন করতে গিয়ে ভিড় বাড়ছে টিকা কেন্দ্রগুলোতে।
গতকাল রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে টিকা নিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে টিকা নিয়েছেন বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গতকাল সারা দেশে টিকা নিয়েছেন ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫১ জন। এর মধ্যে পুরুষ টিকাগ্রহীতার সংখ্যা ১ লাখ ১১ হাজার ৬৯১ জন, নারী ৪৬ হাজার ৭৬০ জন। রাজধানীতে টিকা নিয়েছেন ১৯ হাজার ১১৫ জন। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে টিকা নিয়েছেন ৯৬৪ জন, সচিবালয় ক্লিনিকে ৩০৯ জন, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে ৭০০ জন, মোহাম্মদপুর ফারটিলিটি সেন্টারে ৩৭০ জন, মাতুয়াইল মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ৪৮২ জন, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ৯৯০ জন, কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে ৫৫২ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৮৬০ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা নিয়েছেন ৯৩০ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১ হাজার ৩০ জন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯০৬ জন, শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৪২৬ জন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ১ হাজার ৮৩৭ জন। হাসপাতালগুলোতে তাৎক্ষণিক নিবন্ধন করে টিকাগ্রহীতার সংখ্যা বাড়ছে। দুই দিন ধরে তাৎক্ষণিক নিবন্ধনের কারণে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে দৈনিক সক্ষমতার তুলনায় বেশি মানুষকে টিকা দিতে হচ্ছে। এতে টিকা প্রদানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে আগে নিবন্ধন করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি বুথে দিনে ১ হাজার ২০০ মানুষের টিকা দেওয়ার কথা। কিন্তু গতকাল সেখানে ১ হাজার ৮৩৪ জন মানুষ টিকা নিয়েছেন। এর আগের দিন সেখানে টিকা নিয়েছেন ১ হাজার ৪৯৭ জন। বিএসএমএমইউ-এর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আহমেদ আমিন বলেন, নিবন্ধন এখন আমাদের সক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এটি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে সিস্টেম ব্যাহত হয়। সিস্টেমবিহীন হয়তো ১০০ মানুষকে টিকা দেওয়া যায়, হাজার হাজার মানুষকে দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, ‘বুধবার আমাদের হাসপাতালে নির্ধারিত তালিকার বাইরে ৪০০-এর বেশি মানুষ টিকা নিয়েছেন। আমি জানি না বৃহস্পতিবার কতজন আসবে, কত টিকা আনব। এভাবে সুন্দর ব্যবস্থাপনাটাই নষ্ট হয়ে যাবে।’
গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, কেউ রেজিস্ট্রেশন করতে ব্যর্থ হলে তিনি যদি জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে টিকাদান কেন্দ্রে যান, সেখানে রেজিস্ট্রেশন করে টিকা দিতে পারবেন। সেই ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে চেক করা হবে, তিনি কেন রেজিস্ট্রেশন করেননি। এ নির্দেশনার পর থেকে হাসপাতালগুলোতে তাৎক্ষণিক নিবন্ধন করে টিকা নেওয়ার হার বাড়ছে। মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সেন্টারের পরিচালক ডা. মনিরুজ্জামান সিদ্দিকি বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে এলেই টিকা দেওয়ার এই নির্দেশনার পর গত মঙ্গলবার থেকে আমাদের এখানে চাপ অনেক বেড়েছে। এখন তাৎক্ষণিক নিবন্ধন করে অনেকেই টিকা দিতে চাচ্ছে। তবে সেটি আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, যাবতীয় আয়োজন আমরা করেছি, জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে এলে আমরা নিবন্ধন করে দিচ্ছি। কিন্তু তারপরও অনুরোধ থাকবে যাদের সুযোগ আছে, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ৩-৪ মিনিট সময় ব্যয় করে নির্ধারিত তারিখে টিকা নিতে আসুন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ও মুখপাত্র রোবেদ আমিন বলেন, সেন্টারগুলোতে নিবন্ধন করে দেওয়ার মানুষ রয়েছে। তবে তাৎক্ষণিক নিবন্ধন সংখ্যা বাড়লে সেগুলো সামলানো কঠিন হয়ে যাবে হাসপাতালগুলোর জন্য। একান্তই অসুবিধা না হলে রেজিস্ট্রেশন করে কার্ড নিয়ে টিকা নিতে সেন্টারে গেলে সবচেয়ে ভালো হয়। আমাদের আহ্বান থাকবে একটু কষ্ট করে সবাই আগে রেজিস্ট্রেশন করে টিকা নিতে যান। এতে হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষে সবার তথ্য সুন্দর করে সংরক্ষণ করা সহজ হবে।
টিকা নিলেন বিদেশি কূটনীতিকরা : ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছে সরকার। গতকাল বিকালে মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে এই টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়। প্রথম দিনে সেখানে ঢাকায় ডিপ্লোমেটিক কোরের ডিন ভ্যাটিক্যান সিটির রাষ্ট্রদূতের পাশাপাশি ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি, তুরস্ক, ফ্রান্স, ইতালি, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের মিশন প্রধানসহ প্রায় ৩০ জন কূটনীতিক টিকা নেন। টিকা নিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনও। অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে যতটি দেশের কূটনীতিকরা আছেন, সবার জন্য আমরা আলাদাভাবে এখানে আয়োজন করেছি। আজকে (বুধবার) ৩০ জনেরও অধিক কূটনীতিক এসেছেন। পর্যায়ক্রমে ১ হাজার ২০০ এর অধিক কূটনীতিক বাংলাদেশে যারা আছেন, তারা সবাই টিকা নেবেন।’ কূটনীতিকদের টিকা দেওয়ার জন্য শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিদেশি মিশনের বাইরে আন্তর্জাতিক সংস্থার দফতরে কর্মরত বিদেশিদের তালিকাও চেয়েছে সরকার। তারাও এ হাসপাতাল থেকে টিকা নেবেন। টিকা নিয়ে আমরা যেমন আত্মবিশ্বাসী, তারাও (কূটনীতিক) তেমনই আস্থাশীল। টিকা নিয়ে ঢাকায় কূটনৈতিক কোরের ডিন আর্চবিশপ জর্জ কোশারি বলেন, ‘এখানে কূটনৈতিকদের পক্ষ থেকে টিকাদান শুরুর জন্য আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। দয়া করে সবাই টিকা নিন, যাতে মহামারী ক্ষীণ হয়ে আসে এবং দেশ অগ্রসর হতে পারে। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতা কোন পর্যায়ে রয়েছে, এটা তার প্রতিফলন। এক্ষেত্রে সহজ বাস্তবতা হচ্ছে, দুই দেশকে একই সঙ্গে টিকাদান কর্মসূচি চালাতে হবে। ভারত, বাংলাদেশ ও আমাদের প্রতিবেশীরা একই সঙ্গে টিকা নিতে হবে।’
বেসরকারি খাতকেও টিকা কার্যক্রমে যুক্ত করা হবে : সারা দেশে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রমে বেসরকারি খাতকেও সম্পৃক্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল ‘জাতীয় কভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম : বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের সম্পৃক্ততা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এ কথা বলেন তিনি। বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। আলোচনায় অংশ নিয়ে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রমে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সম্পৃক্ত করার দাবি জানান বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের নেতারা। পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, বেসরকারি খাত টিকাদান কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখানোয় আমরা আনন্দিত। আপনারা যুক্ত হতে চান, যেভাবে আপনারা পরীক্ষা এবং চিকিৎসায় যুক্ত হয়েছিলেন। এ বিষয়ে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। আশা করি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে আপনারাও টিকা প্রদান কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারবেন।’ তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়া শুরু করতে যেসব নিয়মকানুন, শর্ত আছে, সেগুলো পালন শেষে কাজটি শুরু হবে।
স্বাস্থ্য খাতে ৬০ শতাংশ সেবা দেয় বেসরকারি খাত। কাজেই তারা কেন বাইরে থাকবেন? তারা সব কাজে যোগ দেবেন, এই সহযোগিতা আমরা করব।’ আলোচনা সভায় বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম এ মুবিন খান করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রমে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করার দাবি জানান। বেসরকারি হাসপাতালে বিক্রির জন্য প্রাথমিকভাবে সরকারের কাছে ১০ লাখ ডোজ টিকা চেয়ে তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা, চিকিৎসা সেবা দেওয়া- সব ক্ষেত্রেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে। তাহলে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন তাদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, টিকা দেওয়ার জন্য বেসরকারি হাসপাতালের অনুমোদন ও মূল্য নির্ধারণ করে দেবে সরকার। এখন বেসরকারি হাসপাতাল থেকে টাকার বিনিময়ে নমুনা পরীক্ষা করা যায়। টিকার ক্ষেত্রেও কেউ চাইলে সরকারি বিনামূল্যের টিকা নিতে পারবেন, চাইলে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে টিকা কিনে নিতে পারবেন। বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, স্বাচিপের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ, বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়ানস্টিক সেন্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া, আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান আনোয়ার খান উপস্থিত ছিলেন।