দেশব্যাপী সবজির বাম্পার ফলন হলেও কৃষক পাচ্ছেন না ন্যায্য দাম, উঠছে না উৎপাদন খরচ। উৎপাদিত সবজি অনেক সময় পানির দরে বিক্রি করছেন কৃষক। এতে চাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ধানের পর এবার দেশে পেঁয়াজ, রসুন, মরিচসহ ১৪টি কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ নিরূপণ করেছে সরকার। গত প্রায় এক বছর মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন ও কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করে এই মূল্য নির্ণয় করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।
এবার সংশ্নিষ্ট অন্যান্য দপ্তরকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুতই উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করে তা প্রকাশ করা হবে। এই প্রক্রিয়া শেষ হলেই সবজির বাজারমূল্যও নির্ধারণ করা যাবে বলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানিয়েছে। অধিদপ্তর বলছে, মূল্য নির্ধারণ হলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে। এতে চাষিদের পাশাপাশি ভোক্তারাও লাভবান হবেন।
গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ সমকালকে বলেন, আমরা নিয়মিতই কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে থাকি। চালসহ অন্যান্য অনেক পণ্যের উৎপাদন খরচ ও মূল্য নির্ধারণ করা হলেও কিছু মসলাজাতীয় পণ্য ও সবজির উৎপাদন খরচ এখনও নির্ধারণ হয়নি। এবার আমরা এগুলোর উৎপাদন খরচ নির্ণয় করেছি। খুব দ্রুতই উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এ ছাড়া অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ করে সরকার এগুলোর বাজারমূল্যও নির্ধারণ করবে বলে জানান মোহাম্মদ ইউসুফ।
১৪টি কৃষিপণ্যের প্রতি কেজির গড় উৎপাদন খরচ হলো- পেঁয়াজ ১৯.২৪ টাকা, রসুন ৩০.৮৭ টাকা, মরিচ ১৯ টাকা, সরিষা ৩৩.৪৪ টাকা, মসুর ডাল ৪০.৩২ টাকা, ফুলকপি ৭.৪২ টাকা, বাঁধাকপি ৭.০৭ টাকা, শিম ১০.১৩ টাকা, টমেটো ৮.২১ টাকা, শসা ৮.০৪ টাকা, বেগুন ৯.২০ টাকা, লাউ ৫.৩৩ টাকা, কাঁচা পেঁপে ৪.২৭ টাকা ও ঢেঁড়স ১০.৭৯ টাকা।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, এর আগে কখনোই সবজির উৎপাদন খরচ কিংবা বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। কৃষক ও ভোক্তার সুবিধার্থে এ বছর আমরা এই উদ্যোগ নিয়েছি। কৃষক এতে লাভবান হবেন। প্রণোদনা, ঋণ, ভর্তুকি, ক্ষতিপূরণ কিংবা সরকারের কোনো পরিকল্পনা প্রণয়নেও এটি কাজে লাগবে।
তিনি বলেন, যেসব জেলায় সবচেয়ে বেশি সবজি উৎপাদন হয়, সেসব এলাকা আমরা পরিদর্শন করেছি। প্রতিটি জেলায় ছোট, বড় ও মাঝারি কৃষকের সঙ্গে কথা বলেছি। জমির মূল্য, শ্রমিক খরচ, সার, বীজের দাম, কীটনাশক খরচ ও ঋণের সুদ হিসাব করেই এই খরচ নির্ণয় করা হয়েছে। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সঙ্গেও এ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সরকারি হিসাবে, বছরে দেশে সবজির চাহিদা এক লাখ ৬২ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছর দেশে বিভিন্ন প্রকার সবজি উৎপাদন করা হয়েছে এক লাখ ৭২ হাজার টন। চাহিদার তুলনায় ১০ লাখ টন সবজি বেশি উৎপাদন করা হলেও দামের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকের পাশাপাশি ভোক্তাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। মাঝখান থেকে ফায়দা লুটে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।
মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতেই চাল, আলুর পর এবার সবজি ও মসলাজাতীয় পণ্যের উৎপাদন খরচ নির্ণয় করা হয়েছে বলে জানান মোহাম্মদ ইউসুফ। তিনি বলেন, সরকার আলু ও চালের যে দর ঠিক করে দিয়েছে, তা হয়তো শতভাগ কার্যকর হয়নি, তবে অস্বাভাবিক হারে বাড়ানোর সাহসও পায়নি। দর নির্ধারণ করে দেওয়ার ফলে এটুকু উপকার তো সাধারণ মানুষ পেয়েছে। বাজারে সবজির দর ঠিক করে দেওয়ার পর বাজার অস্থির হলে মনিটর করা সহজ হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্নিষ্টরা বাজার মনিটরিং জোরদার করবে। এতে সাধারণ ক্রেতারা উপকৃত হবেন। সবচেয়ে বড় কথা, মাঠ পর্যায়ে কৃষক উপকৃত হবেন।
সবজির উৎপাদন খরচের বিষয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক খানির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম মাসুদ সমকালকে বলেন, শুধু উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করলেই হবে না, কৃষক যাতে উৎপাদিত পণ্য যৌক্তিক মূল্যে বিক্রি করে লাভবান হতে পারেন, সেদিকে নজরদারি থাকতে হবে। কারণ কৃষকরা তাদের কষ্টার্জিত উৎপাদিত পণ্য যথাযথ মূল্যে বিক্রি করতে না পারলে উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বেন। তাই উৎপাদিত সবজির নূ্যনতম বাজারমূল্য নির্ধারণ করে কৃষক পর্যায়ে তার প্রাপ্তি নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমরা কৃষি মূল্য কমিশন গঠন করার দাবি জানিয়ে আসছি। পৃথিবীর বহু দেশে কৃষকের স্বার্থে এমন কমিশন গঠন হয়েছে। এ ছাড়া কৃষক শুধু ন্যায্য দাম পেলে হবে না, বাজারদরের আপডেটও মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের নিয়মিত দিতে হবে।