বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ঘিরে ক্রমেই সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব এই জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও রোল মডেলে পরিণত হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে গ্লোবাল স্ট্যাটাসের রিপোর্ট অনুযায়ী বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। আর নবায়নযোগ্য শক্তি খাতের বৈশ্বিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিনিউঅ্যাবল এনার্জি এজেন্সির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সৌরবিদ্যুৎ খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। এর মাধ্যমে দেশের ১ লাখ ৩৭ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, দেশে এখন ২৩টি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে চলমান আছে। আর এগুলো বাস্তবায়ন হলে এর মাধ্যমে ১ হাজার ২২০ দশমিক ৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। আশার কথা, সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে দেশের ১ কোটির বেশি মানুষ প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছে। আবার নবায়নযোগ্য জ্বালানির ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ খরচও অন্যান্য জ্বালানির তুলনায় কম।
স্রেডার দেওয়া তথ্যে, বর্তমানে সৌর প্যানেল (সোলার প্যানেল) থেকে ৪১৫ মেগাওয়াট, বায়ু থেকে ২ দশমিক ৯ মেগাওয়াট, জল থেকে ২৩০ মেগাওয়াট, বায়োগ্যাস থেকে দশমিক ৬৩ মেগাওয়াট এবং বায়োম্যাস থেকে দশমিক ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। আবার ভালো সম্ভাবনা থাকায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বিনিয়োগে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ অংশীদারি কোম্পানি গঠনে চুক্তি করেছে চীন। নবায়নযোগ্য জ্বালানির মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে সৌরবিদ্যুৎ। বর্তমানে সারা দেশে ১ হাজার ৪৬৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার সোলার পার্ক স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। সরকারি বিভিন্ন ইউটিলিটি কর্তৃক আরও ৩৯০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সোলার পার্ক স্থাপনের কার্যক্রম বাস্তবায়নাধীন আছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ১ হাজার ৯৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সোলার পার্কের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা সম্ভব হবে। দেশের গ্রিডবহির্ভূত গ্রামীণ এলাকায় বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ইডকলসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দ্বারা এরই মধ্যে প্রায় ৫৮ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে প্রতি বছর ২২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ১ লাখ ৮০ হাজার টন কেরোসিন সাশ্রয় হয়েছে। এ ছাড়া দুর্গম ও দ্বীপাঞ্চলে সোলার মিনিগ্রিড প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ পর্যন্ত ১৯টি সোলার মিনিগ্রিড প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আরও ৯টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। স্রেডার তত্ত্বাবধানে ইডকল কর্তৃক মনপুরা দ্বীপকে ১০০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক দ্বীপ হিসেবে গড়ে তুলতে বিদ্যুতায়নের কার্যক্রম চলমান আছে। কিছুদিন আগেই ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরে সুতিয়াখালী ৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প পরীক্ষামূলক উৎপাদনে গেছে। ১৭৪ একর জমির ওপর ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ পর্যন্ত এটি দেশের সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প।
দেশে এখন পর্যন্ত রুফটপ সোলার সিস্টেম থেকে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৫২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ সিস্টেমকে জনপ্রিয় করার জন্য নেট মিটারিং গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের সব সরকারি-আধাসরকারি অফিস ভবন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাদে নেট মিটারিং পদ্ধতিতে রুফটপ সোলার সিস্টেম স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উপকূলীয় এলাকা ও উত্তরাঞ্চলে, যেখানে সুপেয় পানির অভাব, সেখানে ১৫২টি সোলার ড্রিংকিং ওয়াটার সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। এর বাইরে সিরাজগঞ্জে ১০০, পাবনার সুজানগরে ৬০ ও বেড়ায় ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা সৌরবিদ্যুতে ভালো করছি। এরই মধ্যে দেশের ৫৮ লাখ বাড়িতে সোলার সিস্টেম বসানো হয়েছে। ৬২টি সোলার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর বাইরে বড় আকারে সৌরপার্ক স্থাপনে ১ হাজার একর জমিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করছি।’
নবায়নযোগ্য জ্বালানির মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ ছাড়াও ভালো সম্ভাবনা আছে বায়ুবিদ্যুৎ ঘিরে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বায়ুশক্তি থেকে ১ হাজার ১৫৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এজন্য নাটোর, চাঁদপুর, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ, হবিগঞ্জ ও খুলনায় উইন্ড রিসোর্স ম্যাপিং প্রকল্পের আওতায় বায়ুপ্রবাহের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে। বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে ও প্রকল্প গ্রহণে স্রেডার উদ্যোগে বিশেষ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন কর হয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে দেশের তিনটি স্থানে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বায়ুভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম চলমান আছে। এ ছাড়া ফেনীর সোনাগাজীতে ভারতীয় কোম্পানি উইন্ড এনার্জি প্রাইভেট লিমিটেড ৩০ মেগাওয়াটের উইন্ড মিল নির্মাণ করতে যাচ্ছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার পায়রায় বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর পশ্চিম পারে চায়না ক্রসবাঁধ ঘেঁষে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে চলতি বছরের শুরুতে উদ্বোধন করা হয়েছে আরও একটি বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র।