গাফফার খান চৌধুরী ॥ ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ- করায় স্বস্তি ফিরেছে জনমনে। ইতোমধ্যেই মৃত্যুদ-ের আইন মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা হয়েছে। এখন আইন দ্রুত কার্যকর করা হবে বলেও সরকারের তরফ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ- করার কারণে দেশে ধর্ষণ কমবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে অবশ্যই আইন দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। মামলা নিষ্পত্তিও করতে হবে দ্রুততার সঙ্গে।
তবে গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, কোন কোন মহল এমন আইন পাসের পরও খুশি হয়নি। তারা ধর্ষণ ইস্যুতে চলমান আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। তারা ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন ইস্যুতে চলমান আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ ব্যাপারে গভীর মনিটরিং করা হচ্ছে। এমন অপচেষ্টায় লিপ্তদের আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দেয়া হয়েছে পুলিশের তরফ থেকে।
গত প্রায় দেড় মাসে দেশে আলোচিত অন্তত পঁচিশটি ধর্ষণের ঘটনা আলোচনায় এসেছে। যার মধ্যে রাজধানীতেই অসুস্থ স্বামীকে রক্ত দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে স্ত্রী ধর্ষণ, সিলেটের এমসি (মুরারী চাঁদ) কলেজের সামনে থেকে স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে ছাত্রাবাসে ধর্ষণ, রাজশাহীর তানোরে গির্জায় তিনদিন আটকে রেখে ফাদার কর্তৃক এক কিশোরী ধর্ষণ, চিকিৎসার কথা বলে গাজীপুরের শ্রীপুরে এক রোগীকে বাংলোতে নিয়ে ধর্ষণ, নোয়াখালীতে গৃহবধূকে ধর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে জোরপূর্বক তার নগ্ন ছবি ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ছিল খুবই আলোচিত।
এমন ঘটনার পর থেকেই সারাদেশে নারী, শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ এবং ধর্ষকদের বিরুদ্ধে লাগাতার বিক্ষোভ চলছে। প্রথম দিকে যেসব এলাকায় ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেসব এলাকায়ই বিক্ষোভ হচ্ছিল। পরবর্তীতে এই বিক্ষোভ সারা দেশব্যাপী হতে থাকে। সেই বিক্ষোভে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন। তারা ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাসের আহ্বান জানান। পাশাপাশি আইন দ্রুত কার্যকরের দাবিও করেন তারা। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিষ্পত্তি করার দাবিও ওঠে।
আইনমন্ত্রী আগেই ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবনের পরির্বতে মৃত্যুদ- হচ্ছে বলে জানান। এমনকি ওই আইন পাস করার পাশাপাশি দ্রুত কার্যকর করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমর্থন জানিয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন। সর্বশেষ সোমবার ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদ- করা হয়। এই আইন দ্রুত কার্যকর করার নির্দেশও দেন প্রধানমন্ত্রী।
সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী, বিশিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞ ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, এমন আইন কার্যকর করার কারণে দেশে ধর্ষণের মতো অপরাধ কমে আসবে। আইনটি দ্রুত কার্যকর করতে সরকারের তরফ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছেও বলে জানান আইনমন্ত্রী।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বলেছেন, নারী ও শিশু ধর্ষণ জঘন্যতম অপরাধ। এ অপরাধ কঠোরভাবে দমন করতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদ-ের বিধান করা হয়েছে। এতে দেশ ধর্ষণমুক্ত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খ্যাতিমান অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলছেন, যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণ এরপর ভিকটিমকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি প্রায়ই আলোচনায় আসছে। সারাদেশে আন্দোলন সংগ্রামও হচ্ছে। এ ধরনের অপরাধ একটি মানসিক বিষয়। সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া সমাজে এ ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনা কঠিন। মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। প্রযুক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। প্রযুক্তির কারণে মানুষ যেন নীতি, নৈতিকতা, ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা ভুলে না যায়, তা শেখাতে হবে। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তরে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তাতেই এমন অপরাধ কমবে। ধর্ষণের সাজা যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদ- করায় ভয়ে হলেও ধর্ষণের মতো অপরাধ করার মানসিকতা থেকে ধর্ষকরা সরে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমন আইন দ্রুত কার্যকর করতে। ভিকটিমের পরিবারের পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারলে ধর্ষণের হার আরও কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। সম্প্রতি আদালত এ ধরনের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য ধর্ষণ ইস্যুতে চলমান বিক্ষোভ, সভা সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিহারের অনুরোধ জানান। তিনি এক বার্তায় আরও বলেন, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন ইস্যুতে নানা প্রতিবাদকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপতৎপরতা চলছে। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রবিরোধী কোন কর্মকাণ্ড সতর্কভাবে পরিহারের অনুরোধ করা হচ্ছে। সামগ্রিক চলমান বিষয়গুলো পুলিশ সদর দফতরের নজরে এসেছে। দেশের সামাজিক শৃঙ্খলা ও শান্তি নিশ্চিতকল্পে ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনায় সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ। একইভাবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও নিষ্ঠার সঙ্গে সর্বোচ্চমান বজায় রেখে প্রতিটি মামলার তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করা হচ্ছে। সম্ভবপর দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এসব মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে বিচারের জন্য প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হবে। আদালতের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব ঘৃণ্য অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি হবে। সরকার গণদাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে ধর্ষণের বর্তমান শাস্তি যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদ- করেছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে সর্বক্ষণিক তীক্ষè নজরদারি অব্যাহত আছে।
পুলিশ সদর দফতর অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে, রাষ্ট্র ও সরকারের সর্বোচ্চ সদিচ্ছা সত্ত্বেও একটি স্বার্থান্বেষী মহল বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তৎপরতা চালাচ্ছে। জনগণের প্রত্যাশাকে কৌশলে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা অব্যাহত আছে। এর মধ্য দিয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টাও দেখা যাচ্ছে। পুরো বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে কয়েকটি গোষ্ঠী ও কিছু দল হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। দেশ ও জনগণের স্বার্থে যে কোন মূল্যে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিতে পুলিশ বদ্ধপরিকর।
এ ব্যাপারে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এতে মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে বলে আশা করছি। তারপরেও কোন গোষ্ঠী বা সামাজিক সংগঠন এসব ইস্যুতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সংগ্রাম করে তাতে কোন বাধা নেই। পুরো বিষয়গুলোর আমরা নজরদারি করছি। তবে এমন ইস্যুর সুযোগ নিয়ে কোন সামাজিক বা রাজনৈতিক সংগঠন বা কোন গোষ্ঠী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করতে না পারে এজন্য নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যদি শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হওয়ার মতো কোন লক্ষণ বা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে অবশ্যই তা শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।