সেই এসআই গ্রেফতার

admin
নভেম্বর ১১, ২০২০ ৭:০১ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে যুবক রায়হান আহমদের মৃত্যুর ২৯ দিন পর ওই হত্যা মামলায় প্রধান অভিযুক্ত বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ সাময়িক বরখাস্ত এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া গ্রেফতার হয়েছেন। পুলিশ জানায়, ভারতে পালানোর সময় সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে বিজিবি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, ভারতীয় খাসিয়ারা আকবরকে আটক করে এক যুবকের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশে সোপর্দ করেছে। আকবর গ্রেফতারের খবরে সিলেটের মানুষের উৎকণ্ঠার অবসান হলো। আর রায়হানের পরিবারের পক্ষ থেকে দ্রুত বিচারকার্য সম্পন্ন করে আকবরসহ হত্যাকা-ে জড়িত সবার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। গ্রেফতারের পর এসআই আকবরকে সন্ধ্যা ৫টা ৫৩ মিনিটে কড়া নিরাপত্তায় নিয়ে আসা হয় পুলিশ সুপার কার্যালয়ে। সেখানে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মো. ফরিদ উদ্দিন জানান, রায়হান হত্যাকা-ের তিন দিন পর থেকে জেলা পুলিশ এসআই আকবরসহ জড়িত অন্যদের গ্রেফতারে তৎপরতা শুরু করে। সম্ভাব্য বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হয়। জিজ্ঞসাবাদ করা হয় অনেককে। সব থানা পুলিশকে সতর্ক রাখা হয়। গত রবিবার গোপন সূত্র থেকে খবর আসে আকবর সীমান্ত দিয়ে ভারত পালিয়ে যেতে পারেন। এ খবর পাওয়ার পর জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট থানার ওসিকে বিশেষ নজরদারি বৃদ্ধির নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে কানাইঘাট সীমান্ত এলাকায় সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। গতকাল সকাল ৯টার দিকে ভারত পালিয়ে যাওয়ার সময় সাদা পোশাকে পুলিশ কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে আকবরকে গ্রেফতার করে। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার ভারতে পালানোর সময় আকবরকে গ্রেফতারের দাবি করলেও গ্রেফতারের আগের কয়েকটি ভিডিওতে দেখা গেছে অন্য চিত্র। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, কয়েকজন আদিবাসী খাসিয়া যুবক রশি দিয়ে তার হাত-পা বাঁধছে। অন্য একটি ভিডিওতে বেঁধে রাখা অবস্থায় আকবরকে খাসিয়া যুবকরা জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তাদের প্রশ্নের জবাবে আকবর বলছিলেন, ‘আল্লাহর দোহাই আমি মারি নাই। ছিনতাইয়ের সময় পাঁচ-ছয় জন পিটিয়ে তাকে (রায়হান) মেরেছে। আমি তাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছি।’ ভারতে পালিয়ে আসা প্রসেঙ্গ ওই ভিডিওতে এসআই আকবর বলছিলেন, ‘আমাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছিল দুই মাস গেলে হ্যান্ডল করা যাবে। তাই আমি পালিয়ে এসেছি। অন্য কোনো কারণে আসিনি।’ অন্য আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, এক যুবক আকবরের হাত বাঁধতে চাইলে আকবর অনুনয়-বিনয় করছেন। তখন ওই যুবক বলছে, ‘তুই হ্যান্ডকাফ পরিয়ে অনেক লোককে ঘুরিয়েছিস। তোর হাত বেঁধে ছবি তুলে সিও স্যারকে পাঠাতে হবে।’ ভিডিওগুলোয় যে যুবকদের দেখা যাচ্ছিল তারা বাংলায় কথা বললেও তাদের কণ্ঠস্বর ছিল অবাঙালিদের মতো। ওই ভিডিও দেখে কানাইঘাটের স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন, ভিডিওর যুবকদের কথাবার্তা ও এলাকা দেখে বোঝা গেছে, তারা ভারতের খাসিয়া আদিবাসী হতে পারে।
ভিডিও সম্পর্কে জানতে চাইলে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘আকবরকে জেলা পুলিশই গ্রেফতার করেছে। পুলিশ কোনো ভিডিও করেনি। এর আগে কেউ কোনো ভিডিও করলে সেটা আমরা জানি না।’ পুলিশ সুপার আরও জানান, ‘আমাদের কাছে তথ্য ছিল আকবর ভারতে পালিয়ে যাবে। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা নিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এমনও হতে পারে সে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসার সময়ও গ্রেফতার হতে পারে। জিজ্ঞাসাবাদে সবকিছু জানা যাবে।’ আকবরকে পালাতে কেউ সহযোগিতা করেছেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ‘আকবর মাত্র গ্রেফতার হয়েছে। তাকে তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইতে হস্তান্তর করা হবে। এরপর নিয়ম অনুযায়ী পিবিআই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। আকবরকে পালাতে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা সহযোগিতা করে থাকলেও তদন্তে নিশ্চয় তা উঠে আসবে।’ আকবর গা ঢাকা দেওয়ার পর তাকে সহায়তাকারী হিসেবে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার আবদুল্লাহ আল নোমান নামের এক যুবকের নাম উঠে আসে। আকবরের সঙ্গে নোমানও দেশ থেকে পালিয়েছেন এমন গুঞ্জনও উঠেছিল। নোমান সম্পর্কে পুলিশের কাছে কোনো তথ্য আছে কিনা- জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, ‘ইতিমধ্যে নোমানের বাবা, মা ও স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাকে গ্রেফতারে পুলিশ সচেষ্ট রয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এসআই আকবর গ্রেফতারের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে অপরাধ করে কেউ পার পাবে না।’
এদিকে, গ্রেফতার নিয়ে পুলিশের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সামছুল ইসলাম। তিনি জানান, ভারতীয় খাসিয়ারাই আকবরকে ধরে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। রহিম উদ্দিন নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে তাকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। ভারতীয় খাসিয়াদের সঙ্গে রহিউ উদ্দিনের ব্যবসা রয়েছে। অন্যদিকে, এসআই আকবর গ্রেফতার নিয়ে বিজিবির কাছ থেকে পাওয়া গেছে ভিন্ন তথ্য। বিজিবি-১৯ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. রফিকুল ইসলাম, পিএসসি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তাদের সূত্রের দেওয়া তথ্যমতে রবিবার ভারতের শিলচর থেকে আকবরকে ধরে আনা হয়। গতকাল ভারতীয় খাসিয়ারা আকবরকে পুশব্যাক করে। এ সময় ডোনা সীমান্তের কাঁটাতারের নিচে একটি পাইপ দিয়ে আকবরকে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে আসা হয়। ওই সময় ডোনা এলাকার রহিম উদ্দিন সঙ্গে ছিলেন বলে জানান বিজিবির ওই কর্মকর্তা। সূত্র জানান, আকবরকে আটকের পর রবিবার রাতে নিয়ে আসা হয় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ডোনা বস্তিতে। পরে তাকে হস্তান্তর করা হয় ডোনা বস্তির হেডম্যানের (খাসিয়াদের বস্তিপ্রধান) কাছে। সেখান থেকে তাকে রহিম উদ্দিনের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠানো হয়।
বিক্ষোভ : এসআই আকবর গ্রেফতারের খবরে বিকাল থেকে নগরের বন্দরবাজারে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে ভিড় করতে থাকে সাধারণ মানুষ। বিকাল ৫টা ৫৩ মিনিটের সময় এসআই আকবরকে নিয়ে পুলিশ সুপারের গাড়ি কার্যালয়ের ভিতরে ঢুকলে বাইরে শুরু হয় জনতার বিক্ষোভ। আকবরের ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা।
দ্রুত বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি চায় রায়হানের পরিবার : রায়হান আহমদ হত্যাকা-ের মূল অভিযুক্ত এসআই আকবর হোসেন ভূইয়ার গ্রেফতারের খবর শুনে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন রায়হানের মা সালমা বেগম ও স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি। আকবরসহ হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবার সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবি জানিয়ে মা ও স্ত্রী মামলার কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি জানান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাৎ : সিলেটে পুলিশ হেফাজতে নিহত রায়হানের স্বজনরা গতকাল ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে তাঁর দফতরে সাক্ষাৎ করেছেন। তারা রায়হান হত্যা মামলার সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরেন। এ হত্যাকা-ের সঠিক তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লেখ করেন। সাক্ষাৎকালে উপস্থিত ছিলেন রায়হানের চাচা মইনুল ইসলাম কুদ্দুস, ভগ্নিপতি মোফাজ্জেল আলী, মামাতো ভাই শওকত আলী, সিটি কাউন্সিলর মখলিছুর রহমান কামরান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন। প্রসঙ্গত, ১০ অক্টোবর রাতে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ধরে নেওয়া হয় নগরের নেহারীপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে রায়হান আহমদকে। পরদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে গুরুতর অবস্থায় তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন ফাঁড়ির এএসআই আশেকে এলাহী। প্রথমে ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে রায়হান মারা গেছেন বলে দাবি করে পুলিশ। পরে তার পরিবার ফাঁড়িতে নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ তুললে মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেয়ে ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়াসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিন সদস্যকে প্রত্যাহার করে। রায়হানের স্ত্রীও হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে থানায় মামলা করেন।