সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় ভারত-পাকিস্তান থেকে ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ

Shakil Shahriar
জুন ৩০, ২০২৪ ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

নিজস্ব প্রতিবেদক

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত ২৭ জুন ২০২৩ সালের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এই বৈশ্বিক প্রতিবেদনে ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ওপর প্রাণনাশকারী হামলা, আক্রমণ, তাদের সম্পত্তিতে ভাঙচুরের কথাও উঠে এসেছে মার্কিন প্রতিবেদনে। অন্যদিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ পাকিস্তানেও পরিস্থিতি একইরকম উদ্বেগজনক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানে পুলিশ বিভিন্ন সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হত্যা বা শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে অথবা ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত সহিংসতা থেকে ব্যক্তিদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে বেশ ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, মার্কিন কর্মকর্তারা ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মার্কিন প্রতিবেদনে কয়েক ডজন ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে – সন্দেহভাজন এক রেলওয়ে নিরাপত্তা কর্মকর্তার গুলিতে মুম্বাইয়ের কাছে একটি ট্রেনে এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও তিনজন মুসলমানের ওপর প্রাণঘাতী হামলা উল্লেখযোগ্য। প্রতিবেদনে মুসলিম পুরুষেরা গরু জবাই বা গরুর মাংস বিক্রির ব্যবসায় অংশগ্রহণ করছেন এমন অভিযোগে তাঁদের ওপর হামলার উদাহরণও তুলে ধরা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে গত বছরের মে মাসে সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী কুকি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মেইতেই বা মনিপুরী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সহিংসতার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সহিংসতায় মণিপুরে হিন্দু ও খ্রিস্টানদের উপাসনালয় ধ্বংস করা হয়। স্থানীয় উপজাতীয় নেতাদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেখানে আড়াই শতাধিক গির্জা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, দুই শতাধিক লোক নিহত হয়েছে এবং ৬০ হাজারের বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

অন্যদিকে পাকিস্তানে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে পাকিস্তানে ধর্মীয় বৈষম্য ও টার্গেটিংয়ের ঘটনাগুলোর বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে পাকিস্তান সরকার। কারণ গত বছরে ৩২৯ জনের বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছিল, যার মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছিল।

বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় স্বাধীনতার অবস্থা পর্যালোচনা করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানে পুলিশ বিভিন্ন সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হত্যা বা শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে এবং ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত সহিংসতা থেকে বিভিন্ন ব্যক্তিদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, পুলিশের বিরুদ্ধে প্রায়ই নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়, তবে তা হয় হালকাভাবে গ্রহণ করা হয় কিংবা আদও শাস্তি দেওয়া হয় না। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, একটি মামলায় তারা নানকানা সাহিবে এক ধর্ম অবমাননাকারী আসামিকে আটক করে, কিন্তু পুলিশ জনতাকে থানায় ঢুকে অভিযুক্তদের গণপিটুনি দেওয়া থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়। সেই ঘটনায় দুই কর্মকর্তাকে তদন্ত মুলতুবি রেখে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত তাদের ‘অবহেলা, অযোগ্যতা এবং কাপুরুষতার’ অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে।

মার্কিন প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে – ২০২১ সালে দুর্গাপূজার উৎসব চলাকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সহিংসতার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ সাজা দিতে ব্যর্থতার অভিযোগে সরকারের সমালোচনা করে আসছেন হিন্দু নেতারা। তবে তাঁরা উল্লেখ করেন, ২০২৩ সালের দুর্গাপূজা সামনে রেখে সরকার অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন, ধর্মীয় সম্প্রীতি উৎসাহিত করতে আন্তধর্মীয় সংলাপ আয়োজনের মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। সেবার উৎসবে কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। এছাড়া , বছরের শেষের দিকে পুলিশ ২০২১ সালের সহিংসতার ১৪২ টি মামলার মধ্যে ১৪১ টির তদন্ত শেষ করেছিল। হিন্দু নেতারা বলেছেন, ওই সহিংসতায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া সব মন্দির পুরোপুরি পুনর্নির্মাণ হবে এমনটা তারা আশা করেননি।

এছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের স্বীকৃতি দেওয়া হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মের মানুষের জন্য সমমর্যাদা ও সমানাধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে, এমন ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ক্ষতিকর’ বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ডের জন্য জরিমানা বা দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের সাজা রাখা হয়েছে দণ্ডবিধিতে। তবে এই নিষিদ্ধ বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা দণ্ডবিধিতে নেই।

সরকারকে ‘নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী বা ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য অবমাননাকর’ ভাষা ব্যবহার করা সংবাদপত্র, সাময়িকী বা অন্য প্রকাশনার সব কপি জব্দ করার অনুমতি দিয়েছে ফৌজদারি আইন। অনলাইন প্রকাশনার ক্ষেত্রেও একই বিধিনিষেধ এ আইনে আরোপ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হলেও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে সমুন্নত রাখা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ধর্মীয় বৈষম্য। বলা হয়েছে, সব ধর্মের মানুষের জন্য সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা। দেশটিতে বিভিন্ন ধর্মের জন্য রয়েছে আলাদা পারিবারিক আইন।

আহমদিয়া সম্প্রদায়ের নেতারা দাবি করেছেন, পঞ্চগড়ের আহমেদনগরে গত বছরের মার্চে তাঁদের বার্ষিক সম্মেলনে শত শত লোক হামলা চালান। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও অন্য সরকারি কর্মকর্তারা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সহিংসতায় দুজনের মৃত্যু হয়, আহত হন অনেকে, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কয়েক শ’ বাড়িঘরে লুটতরাজ ও ভাঙচুর চালানো হয়। হামলা চালানো হয় আহমদিয়াদের একটি মসজিদ ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও। ওই ঘটনার পর পুলিশ কয়েক হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে। গ্রেপ্তার করা হয় সহিংসতার কথিত উসকানিদাতাসহ দুই শতাধিক ব্যক্তিকে।

সরকার দুর্গাপূজা, ক্রিসমাস, ইস্টার সানডে এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমাসহ সহিংসতার সম্ভাব্য লক্ষ্য হিসাবে বিবেচিত অন্যান্য ধর্মীয় স্থান, উৎসব এবং অনুষ্ঠানগুলোতে আইন প্রয়োগকারী কর্মীদের মোতায়েন অব্যাহত রেখেছে।