রাইসির মৃত্যু: এবার কি নতুন খেলায় মাতবে পশ্চিমারা?

Shakil Shahriar
মে ২১, ২০২৪ ১০:১৮ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

পশ্চিমাদের আধিপত্য দমন করে উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্যে অন্যতম ক্ষমতাধর দেশ এখন ইরান। ক্রমাগত নিষেধাজ্ঞা এবং হুমকিও টলাতে পারেনি তাদের। তেহরানকে এমন উচ্চতায় বসাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির। মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে দেখিয়েছেন মুনশিয়ানা। কিন্তু তার মর্মান্তিক বিদায়ে প্রশ্ন উঠেছে, এই সুযোগে পশ্চিমারা নতুন কোনো খেলায় মেতে উঠবে না তো?

যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে ইরানকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছানো এক প্রতাপের নাম ইব্রাহিম রাইসি। তেহরান যখন তার নেতৃত্বে বিশ্ব পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তনের সূচনা করছে, ঠিক তখনই মর্মান্তিক মৃত্যু হলো ইব্রাহিম রাইসির। রাইসির মৃত্যুতে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্নও।
ইরানকে পঙ্গু করতে নিষেধাজ্ঞার খেলায় মেতে আছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা জোট। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নিষেধাজ্ঞার ভেতরেই লড়ছে তেহরান। তবে পশ্চিমাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ এখন তারা। শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলের সঙ্গে বৈরি সম্পর্ক চলে আসছে দেশটির। তেহরানকে দমাতে কম ফন্দি আঁটেনি তেল আবিবও। বিশেষ করে ইরানি ভূখন্ডে সাম্প্রতিক হামলা তারই প্রমাণ। 
বছরের পর বছর ধরে রাইসি সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তবে মুখোমুখি সংঘাত এড়িয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে দাপট দেখিয়ে তা ভিন্ন কৌশলে মোকাবিলা করেন ইব্রাহিম রাইসি।
১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে হটানো, আঞ্চলিক প্রাধান্য বজায় রাখা এবং চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে মূল্যবান জোটগুলোকে শক্তিশালী করাই ছিলো ইরানের লক্ষ্য। এরই ধারাবাহিকতায় মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব হয় ব্যাপক এবং বহুমুখী। 

চলমান গাজা সংঘাতকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস, লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে চলেছে ইরান। একসঙ্গে বিবেচনা করলে, দেশটি স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রকে নাস্তানাবুদ করতে বিরাট প্রভাব বলয় তৈরি করেছে। বাহরাইন, জর্ডান এবং মিশর এই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বলয় মেনে নিয়েছে। 

আর গেল বছর সৌদি আরব ও ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার চুক্তির মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন যুগের সূচনা করে তেহরান। বৈশ্বিক মেরুকরণের অংশ হিসেবে ইব্রাহিম রাইসি ক্ষমতায় আসার পর বিরাট সখ্য তৈরি হয় আগে থেকেই বন্ধুদেশ রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে। মূলত চীন ও রাশিয়াকেন্দ্রিক মধ্যপ্রাচ্যে যে বলয় সৃষ্টি হয়েছে, অঞ্চলটির ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়ে কাজ করছে ইরান।
 

ইরান সামরিক শক্তির পাশাপাশি অর্থনীতিতেও অন্যতম বড় নিয়ামক। তেল ও গ্যাস রফতানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দেশটি। এর অর্থনৈতিক প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর ওপরও প্রভাব ফেলে। বিশ্বের প্রায় ৫০ ভাগ বাণিজ্য হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে। যুদ্ধের ফলে ইরান এ প্রণালি বন্ধ করে দিলে তার নেতিবাচক প্রভাব বিশ্বের পাশাপাশি মার্কিন অর্থনীতিতেও পড়বে। 

রাইসির মৃত্যুতে পশ্চিমাদের ‘রহস্যজনক নীরবতা’

বিশ্বের কোনো প্রান্তে কিছু ঘটলেই ‘অতি উৎসাহ’ নিয়ে এগিয়ে আসে পশ্চিমা বিশ্ব। দেশে দেশে তাদের অযাচিত হস্তক্ষেপও অজানা নয়। কিন্তু হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুতে যেন ‘রহস্যজনক নীরবতা’ পালন করছেন পশ্চিমা নেতারা। এত বড় ঘটনায় তাদের এমন নীরবতা কেন, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
 
সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা বলছে, বেলজিয়ামে সোমবার (২০ মে) ছিল জাতীয় ছুটির দিন। এই কারণে রাইসির মৃত্যুর ঘটনায় ইউরোপ থেকে প্রতিক্রিয়া আসছে না বলে মনে করছেন কেউ কেউ। তবে গত সপ্তাহে স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকোর ওপর হামলার ঘটনার পর যত দ্রুত প্রতিক্রিয়া আসে, তার সঙ্গে তুলনা করলে ইরানের ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।

এই ঘটনাকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের টানাপোড়েনের বড় প্রমাণ হিসেবে দেখছেন অনেক বিশ্লেষক।  আল জাজিরা জানিয়েছে, শুধুমাত্র ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমিরাবদুল্লাহিয়ান এবং দুর্ঘটনায় পড়া হেলিকপ্টারে থাকা অন্যদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। 

এটি মূলত, রোববার (১৯ মে) রাতে বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটির সন্ধানে সহায়তা করার জন্য ‘র‌্যাপিড রেসপন্স ম্যাপিং সিস্টেম’ সক্রিয় করতে ইরানের এক অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় কমিশনের সাড়া।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপীয় কমিশন ইরানের অনুরোধে সাড়া দিয়েছে ঠিকই, তবে রাইসিসহ অন্য কর্মকর্তাদের মৃত্যুর খবর আসার পর। তবে এর মধ্যদিয়ে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক সত্ত্বেও ইইউ এবং ইরানের মধ্যে এখনও কূটনৈতিক চ্যানেল খোলা রয়েছে। 

আল জাজিরার প্রতিবেদন মতে, ব্রাসেলসে এখন ‘অদ্ভূত এক নীরবতা’ বিরাজ করছে। ইউরোপীয় নেতারা ইরানের পরিস্থিতি `খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ’ করছেন। কূটনৈতিক নানা কৌশলের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অব পাওয়ার ইরানের হাতে রাখতে মুনশিয়ানা দেখিয়েছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। এ অবস্থায় তার আকস্মিক মৃত্যুতে মধ্যপ্রাচ্যের ক্রান্তিকালে এ অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বজায় থাকবে কি না, সেই শঙ্কাই করছেন অনেক বিশ্লেষক।