ঢাকার খালগুলো দেখভালের জন্য বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় দেওয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৬টি এবং দক্ষিণ সিটির ১৩টি খাল দখলমুক্ত করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। প্রথমে এসব খালে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনা হবে। এজন্য ঢাকার কোনো ভবন থেকে পয়োবর্জ্য আর খালে ফেলতে দেওয়া হবে না। আর স্বচ্ছ পানিতে মাছ চাষের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। দুই পাড়ে সারি সারি গাছ এবং হাঁটার চওড়া রাস্তা তৈরি করা হবে। খালের পানি যাতে সারাবছর পরিষ্কার রাখা যায় তার জন্য খাল দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, খালের পানি পরিষ্কার রাখতে ঢাকা শহরের আবাসিক, বাণিজ্যিক ভবন ও অন্যান্য স্থাপনায় সেপটিক ট্যাঙ্ক বসানো বাধ্যতামূলক করছে সিটি করপোরেশন। আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে নিজ উদ্যোগে ভবন মালিকদের সেপটিক ট্যাঙ্ক বসানো সম্পন্ন করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে সেপটিক ট্যাঙ্ক স্থাপন না করলে ১ এপ্রিল থেকে অভিযান পরিচালনা করা হবে। নিয়ম না মানলে সংযোগ বিচ্ছিন্নসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এজন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ইতোমধ্যেই গণমাধ্যমে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এ সপ্তাহেই দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম সময়ের আলোকে জানান, কাগজ-কলমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে ২৬টি খাল রয়েছে। আমাদের প্রথম লক্ষ্য হলো খালগুলোর দুই পাড়ের সীমানা নির্ধারণ করা এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে খালের জায়গাগুলো উন্মুক্ত করা। দীর্ঘদিন ধরে খালগুলোর দুই পাড় বেদখল হয়ে আছে এবং জঞ্জালে ভরপুর, তাই খালগুলোর উদ্ধারকাজ বেশ চ্যালেঞ্জের হচ্ছে। অভিযানে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, খালের পাড় অবৈধ স্থাপনায় ভরপুর। অনেকেই স্থায়ী বাসাবাড়িসহ নানা রকম অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। এজন্য আমরা বিভিন্ন এলাকায় অভিযান শুরু করেছি। অভিযানের আগে দখলকারীদের জানাচ্ছি, যেন তারা তাদের স্থাপনা সরিয়ে নেয়। দেখা গেছে, কেউ ৩০ বছর আগে পাকা দালান ঘর করেছে, কেউ ৪০ বছর আগে পাকা ঘর করেছে খালের জায়গায়। এগুলো উচ্ছেদ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। তবে আমি বলেছি, সিএস দাগে যদি খালের জায়গা ৬০ ফুট থাকে তা হলে আমি ৬০ ফুট জায়গাই দখলমুক্ত করব, কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
খাল নিয়ে দ্বিতীয় পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছেÑ দখলমুক্ত খালগুলো খনন করে এর গভীরতা বাড়ানো। দুই পাড়ে ওয়াকওয়ে এবং সাইকেল লেন নির্মাণের পাশাপাশি গাছও লাগানো হবে। এ ছাড়া খালগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করার ব্যবস্থাও চালু করা হবে। খাল সংস্কারে ওয়াসার বাজেট রিভাইসড করা হচ্ছে। উত্তর সিটি করপোরেশন এরই মধ্যে ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে ২৯ কিলোমিটার খাল রয়েছে। সেগুলো প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করে দখলমুক্ত ও সংস্কার করা হবে। এতে ঢাকার জলাবদ্ধতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ঢাকা উত্তরের মেয়র আরও বলেন, নগরীর কোনো জায়গায় জলাবদ্ধতা থাকে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা, কোথাও থাকে এক দিন-দুদিন। এভাবে জলজট লেগে থাকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। খালগুলো সংস্কার করে আমরা রাজধানীর জলজট কমাতে চাই। তবে এই জঞ্জাল ৩০ বছরের। আমি যদি বলি হুট করেই সব জঞ্জাল দূর করে ফেলব, তা হলে সেটি ভুল বলা হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা কাজ শুরু করেছি, জনগণও কাজ দেখছে। তা ছাড়া এ কাজে জনগণের সহযোগিতাও লাগবে। খাল উদ্ধারে গেলে আমরা জনগণের ভালো সাড়া পাচ্ছি। খাল উদ্ধারে মানুষের সমর্থন আমাদের জন্য বড় সাহস জোগাচ্ছে। তবে কাজ করতে গেলে বাধা আসবে, সমস্যা হবেই তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। তবে খালগুলো তো আর এক দিনে বেদখল হয়নি বা ভরাট হয়নি। ৩০ বছর আগে থেকে যদি উদ্যোগ নেওয়া হতো তা হলে এখন এত বেগ পেতে হতো না। খালগুলো এতদিন ওয়াসার কাছে অবহেলিতভাবে ছিল। খালগুলোকেই যদি মেরে ফেলা হয় তা হলে তো জলজট হবেই। এসব সংস্কারের পর ৩৬৫ দিন যাতে পরিষ্কার রাখা যায় তার জন্য আলাদা পরিকল্পনা রয়েেছ। টেন্ডারের মাধ্যমে খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বেসরকারি পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়া হবে, যাতে সারাবছর খালগুলো পরিষ্কার রাখা যায়।
খালগুলোতে পয়োনিষ্কাশনের পানি আর ফেলতে দেবে না দুই সিটি করপোরেশন। এটা বন্ধ করা গেলে খালের পানি একেবারে স্বচ্ছ থাকবে। তখন খালে মাছ চাষ করা যাবে। শুধু তাই নয়, খালগুলোতে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। পয়োনিষ্কাশনের বর্জ্য ও পানি পড়লে দুর্গন্ধে খালে মাছ চাষ কিংবা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট চালানো যায় না। সেজন্য রাজধানীতে পয়োনিষ্কাশনের আলাদা লাইন স্থাপন করা হবে। ভবন মালিকদের নিজস্ব পয়োনিষ্কাশনের সেপটিক ট্যাঙ্ক বানাতেই হবে। রাজউকের প্ল্যানেও বলা আছে, নিজস্ব সেপটিক ট্যাঙ্ক বানাতে হবে। কিন্তু কেউ সেটি মানে না। সবাই খালের মধ্যে ময়লা ফেলছে।
বিশে^র অনেক দেশেই খালগুলোকে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ঢাকা সিটিতেও সে রকম চিন্তা আছে। খালগুলো সম্পূর্ণভাবে উদ্ধার ও পরিষ্কার করার পর এগুলোতে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট চালু করা হবে। খালগুলোতে যেসব ব্রিজ আছে, সেগুলো উন্নত বিশে^র আদলে উঁচু করলে নৌকা বা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অনায়াসে যাতায়াত করতে পারবে। পুরো ঢাকা শহরে ইন্টারকানেকশন নৌরুট চালু করা হবে। এতে সড়ক পথের ওপর চাপ কমবে, যানজট কমবে। কিন্তু খালের পানিতে ময়লা থাকলে মানুষ পানিপথে ভ্রমণ করবে না। এজন্য যার যার বাসার পয়োবর্জ্য তার নিজস্ব সেপটিক ট্যাঙ্কে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. বদরুল আমিন সময়ের আলোকে বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র একত্রে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর আলোকেই আমরা কাজ শুরু করেছি। পয়োবর্জ্য না ফেলার বিষয়ে উত্তর সিটি করপোরেশন ইতোমধ্যেই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও এ সপ্তাহে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নরগবাসীকে বিষয়টি অবহিত করবে। আসলে আমরা শুরুতেই কঠোর হচ্ছি না। নগরবাসীকে নিজ উদ্যোগে সেপটিক ট্যাঙ্ক তৈরি করতে সময় দেওয়া হচ্ছে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। এর মধ্যে সব ভবনে সেপটিক ট্যাঙ্ক না করলে আমরা ১ এপ্রিল থেকে অভিযানে নামব।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এম সাইদুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, সেপটিক ট্যাঙ্ক যদি ভরে যায় তা হলে সিটি করপোরেশনকে জানাবে, সিটি করপোরেশনের লোকজন গিয়ে পরিষ্কার করে আসবে। এর জন্য একটি ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। এখন সব বাড়ির মালিকই সুয়্যারেজ লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত করে যার যার বাসার পয়োবর্জ্য ফেলছে। যেগুলো সরাসরি যাচ্ছে খালগুলোতে। রাজধানীতে এই পয়োবর্জ্যরে কারণেই এত বেশি অ্যামোনিয়া গ্যাস। খালের পানিতে এই গ্যাস মাত্রাতিরিক্ত থাকলে সে পানিতে মাছ বাঁচবে না। তাই এ বিষয়ে কঠোর হবে সিটি করপোরেশন।
উল্লেখ্য, ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের হাতে ছিল। এরপর পৌরসভা এ দায়িত্ব পালন করত। ১৯৮৮ সালে এটি ঢাকা ওয়াসাকে হস্তান্তর করা হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনের অংশ হিসেবে ঢাকা ওয়াসা শহরের খাল (প্রায় ৮০ কিলোমিটার) এবং প্রায় ৩৮৫ কিলোমিটার বড় আকারের নালা ও চারটি পাম্পস্টেশন এতদিন রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করে আসছিল। দুই সিটি করপোরেশন দেখভাল করে প্রায় ২ হাজার ২১১ কিলোমিটার নালা। গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ লক্ষ্যে সেদিন ওয়াসার সঙ্গে দুই সিটি করপোরেশনের চুক্তি হয়।