১৯৫২ সালের ১৪ জুন। পশ্চিম পকিস্তানের লাহোর নগরী থেকে হায়দ্রাবাদ শহরে অবস্থানরত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দিকে চিঠি লিখেছেন শেখ মুজিবুর রহমান- Please don’t think for me. I have born to suffer। বয়স তাঁর ৩২ বছর। মাত্র সাড়ে তিন মাস আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি একটানা প্রায় আড়াই বছর জেল খেটে মুক্তিলাভ করেছেন। মুক্তিলাভের ঠিক দুই মাস পর তাঁর ওপর অর্পিত হয় নতুন দায়িত্ব- পূর্ব পকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অমর ২১ শে ফেব্রুয়ারির অনন্য আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব প্রদানের কারণে দলটি তখন নতুন মর্যাদায়। কিন্তু সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকসহ অনেক নেতা জেলে। আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা নেওয়া অনেক ছাত্রনেতাও জেলে।
শেখ মুজিবুর রহমান জেলে থেকেই আন্দোলন পরিচালনা ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা নজরদারি নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে ৮ ডিসেম্বরের প্রতিবেদন ছিল এভাবে- ‘ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের ৮ নম্বর বেডের নিরাপত্তা বন্দি শেখ মুজিবুর রহমান ৩০ নভেম্বর বোইনিভাবে ছাত্রলীগ সভাপতি খালেক নেওয়াজ খান এবং অন্য একজনের সঙ্গে আধা ঘণ্টা শলাপরামর্শ করেছেন।’ ১ জানুয়ারি (১৯৫২) আরেক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়- শেখ মুজিবুর রহমানকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য এ সুবিধার অপব্যবহার করছেন।
বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের ১৯৬ পৃষ্ঠাতে লিখেছেন ২১ শে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি চূড়ান্ত করার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জেল ওয়ার্ডে থাকার সুবিধা কাজে লাগিয়ে তিনি আন্দোলনের কয়েকজন পুরোধা ছাত্র ও যুব নেতা- মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, খালেক নেওয়াজ খানসহ অনেকের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল ও আইনসভায় স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচি চূড়ান্ত করার সময়েই তিনি জানিয়ে দেন- কারাগারের ভেতরে থেকে তিনি আন্দোলনের সমর্থনে আমরণ অনশন করবেন। আন্দোলনের নেতাদের কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ফরিদপুর কারাগারে। সেখানেই, সহকর্মী মহিউদ্দিন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে অনশন শুরু করেন। মৃত্যুর শঙ্কা দেখা দেওয়ায় তাকে মুক্তি দেওয়া হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি। ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলন পুনর্গঠন ও দলকে সক্রিয় করার জন্য। মুসলিম লীগ সরকারের প্রচণ্ড দমননীতির কারণে পরিস্থিতি তখন চরম প্রতিকূল। কিন্তু তিনি যে অদম্য। জেল থেকেই ১২ সেপ্টেম্বর (১৯৫১) আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শামসুল হককে লিখছেন- ‘ভয়ের কোন কারণ নাই। আমি জানি, আমি মরতে পারি না। বহু কাজ আমায় করতে হবে।’
পূর্ব বাংলার বাঙালিকে যিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দেবেন ৫০ বছর বয়স পূর্ণ না হতেই- তিনি ২০ বছর পূর্বে বলছেন- ‘জীবনে বহু কাজ বাকি।’ ১৯ বছর পূর্বে বলছেন- ‘আমার জন্মই দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য।’ আমাদের বুঝতে সমস্যা হয় না- এই কাজ স্বাধীনতার জন্য, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। এ জন্য যে কোনো কষ্ট মেনে নিতে তিনি প্রস্তুত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তৃতীয় দফা জেল খাটা হয়ে গেছে। প্রিয়তম স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা একবার গোপালগঞ্জ থানা হাজতে থাকার সময় বলে দিয়েছেন- ‘জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ।’ আরও আগে ১৯৪২ সালে পিতা শেখ লুৎফর রহমানের উপদেশ- ‘বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা মনে রেখ, sincerity of purpose and honesty of purpose থাকলে জীবনে পরাজিত হবে না।’
স্বাধীনতার মহৎ লক্ষ্যকে ধ্র“বতারা রেখে চলার পথে তাঁর আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও সততার অভাব কখনও হয়নি। সাহস ছিল অতুলন। ১৯৬৪ সালের ৭ থেকে ৯ মার্চ আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক সম্মেলনে তিনি বলেছেন- ‘ত্যাগ স্বীকারই যার ঐতিহ্য, তার পক্ষে চুপ করে বসে থাকা সম্ভব নয়।’ সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট প্রদানকালে সংগঠনের শক্তি বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে বলেছেন- ‘শুধু বিবৃতি ও প্রচার কার্যের দ্বারা প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষমতাসীনদের নিকট থেকে কোনো দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। আমরা সক্রিয় কর্মপন্থায় বিশ্বাসী। শুধু কতিপয় নেতার একতায় যে দেশের মুক্তি আসতে পারে এ নীতিতে বিশ্বাস করি না। গণদাবি আদায় করতে হলে শুধু কতিপয় নেতার তথাকথিত একতা নয়, জনগণের একতা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। আর সেই জনগণের একতা নিুতম কর্মসূচির ভিত্তিতে শুধু সক্রিয় ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের মধ্য দিয়েই সম্ভব।’ এই সম্মেলনের দুই মাস আগেই পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ও তাঁর প্রধান সাগরেদ মোনায়েম খানের উস্কানিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়। সম্মেলনে তিনি বলেন- ‘আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য মানবসেবা এবং কোন সম্প্রদায়ের বিরোধিতা নয়। যে কোনো মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। জীবন দিয়ে প্রতিবেশীর প্রাণ রক্ষা করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য।’
দাঙ্গা রুখে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-পেশাজীবীদের সংগঠিত করেন। ইত্তেফাক, সংবাদসহ সকল জাতীয় দৈনিকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে ‘পূর্ব বাংলা রুখিয়ে দাঁড়াও’ অভিন্ন বক্তব্য নিয়ে স¤পাদকীয় প্রকাশে সক্রিয় সহযোগিতা করেন। তাঁর ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটি পরিণত হয় দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে স্মরণিকায় (কোটি মানুষের কন্ঠস্বর) জাতির পিতার কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা লিখেছেন- ১৯৬৪ সাল। ঢাকায় বড় দাঙ্গা হচ্ছে। আব্বা তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে লিফলেট বিতরণ করছেন- ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাড়াও।’ আমরা তখন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে এসে উঠেছি। চারদিকে কিন্তু পাঁচিল নেই, আছে মুলি বাঁশের বেড়া। কিন্তু ওই ছোট্ট বাসাটি হয়ে উঠলো হিন্দু-মুসলমানদের আশ্রয়শিবির। কত মানুষ এসে থাকলো আমাদের বাড়িতে। আব্বার নির্দেশ, মায়ের প্রাণপণ চেষ্টা, কারো যেন সামান্য কষ্ট না হয়। সবাই যেন নিরাপদে থাকে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া পায়। আমরা যা খাই, তা-ই খাবেন সবাই, বিশেষ কোনো খাবার নয়; কিন্তু সবার যেন যত্ন নেওয়া হয়, সবার খেয়াল যেন রাখা হয়। কিন্তু হামলাকারীরা যদি এই বাড়ি পর্যন্ত চলে আসে? আমাদের লাইসেন্স করা বন্দুক আছে। আর কার কার আছে? কোন মামার বন্দুক আছে, কোন চাচার বন্দুক আছে, নিয়ে এসে বড়রা সারা দিন, সারা রাত পাহারা দিতে লাগল।’
আমরা এটাও জানি, ১৯৫৩ সালেই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের দুয়ার সব ধর্মের মানুষের জন্য খুলে দিতে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব তুলেছিলেন। একইসঙ্গে তাঁর সংগ্রাম ছিল ব্রিটিশ আমলের সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের ভোটপ্রথার অবসান ঘটিয়ে যুক্ত নির্বাচন চালুর জন্য। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বলবৎ হওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতা তাই আকস্মিক ছিল না। আধুনিক ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনের জন্য এমন আদর্শ অপরিহার্য, সেটা বঙ্গবন্ধু সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই জানতেন। এ পথে পদে পদে বাধা এসেছে। কিন্তু জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তিনি তা অতিক্রম করেন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ৩২ নম্বরের বাড়িটি পাকিস্তানের নিষ্ঠুর সামরিক জান্তার বিকল্প সরকার পরিচালনার কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। জনগণের ম্যান্ডেট ছিল। কিন্তু ১ মার্চ থেকে সামরিক জান্তাকে রাজপথে চ্যালেঞ্জ জানানোর পাশাপাশি একইসঙ্গে বিকল্প সরকার পরিচালনা- এ তো অনন্য! মহাত্মা গান্ধী সফল অসহযোগ আন্দোলন ও ভারত ছাড় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, আসমুদ্র হিমাচল জুড়ে ব্রিটিশ রাজত্বের ভিত চুরমার করে দিয়েছেন। কিন্তু বিকল্প সরকার পরিচালনা করতে পারেন নাই। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ৩৫ দফায় রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি প্রশাসন পরিচালনা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখা, সংবাদপত্র-বেতার-টেলিভিশন প্রচারসহ প্রয়োজনীয় সকল বিষয় সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের ঐতিহাসিক ৬-দফা প্রদান করেন। এ কর্মসূচি তিনি ঘোষণা করেন শত্রুর ডেরায়, লাহোর নগরীতে। ২৬ বছর আগে ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এই নগরীতেই পকিস্তান গঠনের প্রস্তাব তোলেন, যা বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর ছিল সক্রিয় ভূমিকা। কিন্তু সেই পাকিস্তান যখন পূর্ব বাংলাকে প্রায় উপনিবেশে পরিণত করে ফেলে- তিনি রুখে দাঁড়ান। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গড়ে তোলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, যা দ্রুতই বাঙালির আর্থ-সামাজিক-শিক্ষার অধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান হতিয়ার হয়ে ওঠে। এ সংগঠনের প্রথম সম্মেলনে (১৬, ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯) সভাপতির ভাষণে তিনি ছাত্র-তরুণদের বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান ও অস্ত্রসজ্জিত করার দাবি তোলেন। পরের বছরগুলোকে বাংলার পথে প্রান্তরে সভা-সমাবেশে তিনি সোচ্চার হয়েছেন স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে।
১৯৬১ সালে অধ্যাপক রেহমান সোবহানসহ কয়েকজন তরুণ অর্থনীতিবিদ পাকিস্তানে দুই অর্থনীতির ইস্যু সামনে আনেন। কিন্তু তারও চার বছর আগে ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন- ‘আমরা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চাই? অর্থ, বৈদেশিক নীতি- সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে। পূর্ব পাকিস্তান যদি পশ্চিম পাকিস্তানের সংলগ্ন রাজ্য হতো আমরা তাহলে স্বায়ত্তশাসনের দাবি এভাবে নাও করতে পারতাম। আজ আমরা দেখতে পাই পাকিস্তানে দুইটা অর্থনীতি চলছে। একটা পশ্চিম পাকিস্তানে, আরেকটা পূর্ব পাকিস্তানে। শ্র্রম শিল্পের উন্নয়ন পশ্চিম পাকিস্তানে হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে হয় নাই।’
বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ড নিয়ে এ পর্যন্ত যে সব গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তার প্রতিটিতেই আমরা দেখি স্বায়ত্তশাসন আদায়, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাঁর দৃঢ়সংকল্প ও ঐকান্তিক প্রয়াস। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সরাসরি স্বাধীনতার ডাক দেন। জনগণকে যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেন। ২৫ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত বাঙালির সংগ্রাম ছিল নিরস্ত্র। কিন্তু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাঙালির শত শত বছরের স্বাধীন রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা মূর্ত করে তুলতে বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, সেই স্বাধীন ভূখণ্ড থেকে শত্রুবাহিনী বিতাড়নের জন্য অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাংলাদেশের মানুষ বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে নাই। তিনি যে দেশবাসীকে এ জন্য প্রস্তুত করেছিলেন! আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে গণহত্যার অভিযানের মধ্যেই বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন, যে সরকার ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বিকল্প সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারে। একদিকে মুক্তিবাহিনী শত্রুকে ঘায়েল করে। একইসঙ্গে পরিচালিত হয় নিজস্ব বেতার কেন্দ্র, গঠিত হয় পরিকল্পনা সেল। বাংলাদেশ হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হওয়ার ৩ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতীয় মিত্র বাহিনীর প্রতিটি সদস্য ফিরে যায় স্বদেশে। বিশ্বে এমন ঘটনাও যে নজিরবিহীন!
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা উত্তর পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করেছিলেন। ১৯৬৪ সালের ৭ মার্চ প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদনে ১৯৫৬-৫৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্য উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘যে অল্প সময় আমরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলাম সেই সময়ে যে শুভসূচনা করেছিলাম সেটা রেকর্ডের বিষয়বস্তু।’ তিনি শোষিত জনসাধারণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তেমন কিছু করতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করেন।
এই দুঃখ ঘোচাতে উদ্যোগী হন স্বাধীন বাংলাদেশে। খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রকট, শিল্প বলতে কিছু ছিল না। সাধারণ মানের অবকাঠামো ছিল যুদ্ধে বিপর্যস্ত। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘরে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর লেখা ছিল ‘শূন্য’। এই দেশটি যে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, সে ভরসা উন্নত দেশগুলো করেনি বলেই বাংলাদেশকে আখ্যায়িত করেছিল ‘বাস্কেট কেস’ হিসেবে। কেউ বা আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা হিসেবে একসময়ে পরিচিত এ ভূখণ্ডের অপমান জাতির পিতা সহ্য করতে পারেননি। তিনি মোক্ষম জবাবদানের অপেক্ষায় ছিলেন। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের মঞ্চে বাংলায় ভাষণ দেন। এরপর ওয়াশিংটন যান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে বৈঠকের জন্য। পরে সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন- ‘ওয়াশিংটনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, কেউ কেউ বাংলাদেশকে International Basket Case বলে উপহাস করেন। কিন্তু বাংলাদেশ Basket Case নয়। দুইশ’ বছর ধরে বাংলাদেশকে লুট করা হয়েছে। বাংলাদেশের সম্পদেই শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে লন্ডন, ডান্ডি, ম্যাঞ্চেস্টার, করাচি, ইসলামাবাদের।…. আজো বাংলাদেশে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে। একদিন আমরা দেখাবো বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।’
বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে মুহূর্ত সময় বঙ্গবন্ধু হেলায় হারাতে চাননি। ষাটের দশকে ৬-দফার সামনে রেখে তিনি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয়ী হওয়ার পর সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। তিনি জনগণের ইচ্ছাকে সর্বোচ্চ মূল্য দিতেন এবং এটাই তাঁর বিবেচনায় গণতন্ত্র। শোষণমুক্ত সমাজ বা সমাজতন্ত্রও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন বলপ্রয়োগে নয়, জনগণের সম্মতিতে। ধর্মনিরপেক্ষমতা তাঁর বিবেচনায় প্রতিটি নাগরিকের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। তিনি চেয়েছেন, জনগণ বাঙালি সংস্কৃতি, ভাষা, লোকগান এবং সর্বোপরি বাঙালি পরিবেশ থেকে প্রেরণা পায়। এ প্রেরণাই সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণের চালিকা শক্তি হবে এবং তাঁর কাছে এটাই জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সংজ্ঞায় এটাই মুজিববাদ, আমাদের উন্নয়নের পথে চলার রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে পাথেয়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন কাজের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হলে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রশাসনে মৌলিক পরিবর্তন আনার প্রতি মনোযোগী হন। ১৯৭৫ সালের শুরুতেই তিনি কৃষি-শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দুর্নীতির অবসান, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন, যাকে তিনি অভিহিত করেন দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে। জনগণের সকল অংশকে এ বিপ্লবে সামিল করায় তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মতোই তিনি নিজে নতুন পর্যায়ের এ সংগ্রামে সামনের সারিতে থাকতে চেয়েছেন। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতো
বাংলাদেশের রাষ্ট্র্রপতি পদ গ্রহণ করেন। নবগঠিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশালের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও তাঁর ওপর ন্যস্ত হয়।
কিন্তু বাংলাদেশকে যারা ‘বাস্কেট কেস’ হিসেবেই রাখতে চেয়েছিল, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের জন্য প্রতিহিংসা গ্রহণে যারা সদা মরীয়া, রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি যাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না- সেই অশুভ শক্তি জোট বাঁধে। সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। এ কারণে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসা তারা ছাড়েননি। ১৫ আগস্টের ঘাতকেরা এ সুযোগ গ্রহণ করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অতীতের মতোই ঘাতকদের মুখোমুখি হন। তিনি অসম সাহসে দৃপ্তকণ্ঠে বলেন- ‘বাঙালিরা জাতির পিতাকে হত্যা করতে চাইলে তিনি জীবন দিতে প্রস্তুত। কিন্তু এর পরিণতি শুভ হবে না। তাঁকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রকেও হত্যা করা হবে, মানবিকতা বিদায় নেবে।’
কী ভবিষ্যদ্বাণীই না জাতির পিতা করেছিলেন!
কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা, প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব, সময়োগযোগী পদক্ষেপগ্রহণ এবং বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া দলকে পুনর্গঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করতে পারার কারণে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ায়। বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এখন মর্যাদার সঙ্গে উচ্চারিত নাম। বাংলাদেশের নেতা শেখ হাসিনা এখন সম্মানিত এবং দক্ষ-যোগ্য-সৎ নেতাদের অতিসংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন ওপরের দিকে। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন জনকল্যাণমুখী উন্নয়নের ধারা বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে এগিয়ে চলেছে দৃপ্ত পদক্ষেপে। বাংলাদেশে শেকড় রয়েছে- বিশ্বের নানা দেশে এমন যারা ছড়িয়ে আছেন, আধুনিক প্রযুক্তি যাদের করায়ত্ত, বিনিয়োগের মতো অর্থ ও জ্ঞান মজুদ যাদের- তাদের প্রতি অনুরোধ জননেত্রী শেখ হাসিনা সূচিত ও পরিচালিত উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে আপনারা যে যেভাবে পারেন, সামিল হন। বঙ্গবন্ধু চলার পথ সহজ করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনা ধরে আছেন আলো, যা ক্রমে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বল হচ্ছে। এ দেশ এখন আর বাস্কেট কেস নয়- আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আপনারা তাতে যুক্ত হবেন, অন্যদেরও উৎসাহিত করবেন- এটাই প্রত্যাশা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে চলার নতুন প্রেরণা পাবে, নিশ্চিত করেই তা বলতে পারি।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।