নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশ্রমিকেরা ভয় ও নিপীড়নের পরিবেশের মধ্যে রয়েছেন বলে দাবি করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এখানে কারখানায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো দায়মুক্তি পেয়েছে বলে অভিযোগ করেছে সংস্থাটি। তাদের মতে, এসব ঘটনা খতিয়েও দেখা হয় না। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় মদদে শ্রমিকদের অধিকার দমন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
প্রতিবেদনে রানা প্লাজা ধস, আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে শ্রমিকদের প্রাণহানি এবং ২০২৩ সালে পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলনে দমন-পীড়নের ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
অ্যামনেস্টি বলছে, গত মাসে রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর পূর্ণ হয়েছে। ওই ঘটনায় ১ হাজার ১০০ জনের বেশি পোশাকশ্রমিক নিহত হয়েছিলেন। এর পাঁচ মাস আগে তাজরীন ফ্যাশনসের কারখানায় আগুন লেগে অন্তত ১১২ পোশাকশ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। দুটি ঘটনাই ঘটেছিল কর্মক্ষেত্রে নজরদারির অভাবে। এগুলো ব্যবসাসংশ্লিষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের জঘন্য উদাহরণ বলে উল্লেখ করে তারা।
রানা প্লাজার ঘটনা কেবল বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বেই তোলপাড় তৈরি করেছিল। এরপর নড়েচড়ে বসে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোও। তাদের ওপর চাপ তৈরি হয় পোশাক শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো একজোট হয়ে গঠন করে অ্যাকর্ড। অ্যামেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলো গঠন করে অ্যালায়েন্স জোট। যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ১৬ দফা অ্যাকশন প্ল্যানো বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ সরকার। এরপর থেকে পরিবেশের অনেক উন্নতি হয়েছে, এমনটা স্বীকার করছেন শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা অ্যাক্টিভিস্টরাও। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসটিআর প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসেও অগ্রগতির প্রশংসা করেছেন।
তাদের মতে, কিছু পরিবর্তন তো অবশ্যই হয়েছে। কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আগে যেমন ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে এত চিন্তা করা হতো না, এখন সেটা নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে।
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের খুবই স্বল্প মজুরি দেওয়া হয়। ন্যায়বিচার, মজুরি বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও কর্মক্ষেত্রের উন্নত পরিবেশের দাবিতে সোচ্চার হলেই তাঁরা হয়রানি, ভয়ভীতি ও সহিংসতার মতো নানা বাধার মুখে পড়েন।
গত বছর ন্যুনতম মজুরি কমিশনের বৈঠক শুরুর প্রাক্কালে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করে কিছু সংখ্যক পোশাক শ্রমিক। আশুলিয়া ও গাজিপুর এলাকায় দেখা যায় শ্রমিক অসন্তোষ। এতে বিভিন্ন কারখানা, যানবাহন ভাংচুর করা হয়। গত বছরের ৭ নভেম্বর নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করে সরকার। আর তাতে দেখা যায়, ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ন্যুনতম মজুরি। শ্রমিক বিক্ষোভের মধ্যেই এই মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়। মজুরি নির্ধারণ সংক্রান্ত বৈঠকে মালিকপক্ষ তাদের আগের প্রস্তাব ১০ হাজার ৪০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব দেয়। মজুরি বোর্ডের বৈঠকে সেই প্রস্তাবই গৃহীত হয়। পরে শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি বলেন, এই মজুরি তারা মেনে নিয়েছেন।
‘ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে’– এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে গত ২৩ অক্টোবর থেকে গাজীপুরে আন্দোলন শুরু করেন পোশাক শ্রমিকরা। পরে তা আশুলিয়া, সাভার ও ঢাকার মিরপুরে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক জায়গায় শ্রমিকরা ভাংচুর শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। সংঘাতে এবং এক কারখানায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় প্রাণ যায় অন্তত দুইজনের। পরিস্থিতি সামাল দিতে পর্যায়ক্রমে পাঁচ শতাধিক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
অ্যামনেস্টির হিসাবে, ২০২৩ সালের আন্দোলনের পর থেকে পোশাকশ্রমিকদের বিরুদ্ধে অন্তত ৩৫টি মামলা করা হয়েছে। এতে ১৬১ পোশাকশ্রমিকসহ ৩৫ হাজার ৯০০ থেকে ৪৪ হাজার ৪৫০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। ৩৫টি মামলার মধ্যে ২৫টি এমন সব পোশাক কারখানা করেছে, যেগুলো বিশ্বের বড় বড় ফ্যাশন ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করে।
যেকোনো দাবিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ালে কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করলে ব্যব্স্থা গ্রহণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শিল্প পুলিশের মতে, আন্দোলন করতে শ্রমিকদের বিভিন্ন মহল থেকে ইন্ধন-উসকানি দেওয়া হয়েছে। আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সপার (এসপি) মোহাম্মদ সারোয়ার আলম অসন্তোষ শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ পর জানান, এখানকার অধিকাংশ শ্রমিকই শান্ত ও নিরীহ। শ্রমিকরা কাজে এসেছে, অনেক জায়গায় কাজ চলছে। কিছু কিছু শ্রমিক উচ্ছৃঙ্খলা প্রদর্শন করছে। বিভিন্ন মহল থেকে আন্দোলন করতে শ্রমিকদের ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে, উসকানো হচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যে কিছু মহলকে শনাক্ত করতে পেরেছি। ঢাকা থেকে শ্রমিকদের উসকানি দেওয়া হচ্ছে। সেই জিনিসগুলো আমরা এখানে সম্মুখীন হচ্ছি। তখন পর্যন্ত এসব ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলেও জানান তিনি।
এরপর পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির চলমান আন্দোলনে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় কারখানা ভাঙচুর, মালামাল লুট, কমকর্তা কর্মচারীদের মারধরের অভিযোগে আশুলিয়া থানায় পৃথক মোট ১২টি মামলা হয়েছে। এছাড়া মামলাগুলোতে মোট ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার অজ্ঞাত শ্রমিক ও উস্কানিদাতাদের আসামি করা হয়েছে। শুধু একটি মামলায় ১৬ জন শ্রমিকের নাম উল্লেখ করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
বেতন বাড়ানোর দাবিতে গত ২৩ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে গাজীপুরের বিভিন্ন শিল্প কারখানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও শ্রমিক পুড়ে মৃত্যুর ঘটনায় ১৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১২ হাজারের বেশি লোককে। মামলাগুলোর ৪টিতে বাদী হয়েছে পুলিশ এবং বাকিগুলোতে বাদী হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা কর্তৃপক্ষ।
মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, বহিরাগত প্রায় দুই শতাধিক দুষ্কৃতকারী গাজীপুরের তুসুকার ভিতরে কাজ চলাকালে কারখানায় প্রবেশ করে। পরে বহিরাগত দুষ্কৃতকারীরা কারখানার শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে সবকটি ফ্লোরে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়।
এজহারে বলা হয়, এ সময় কারখানার কর্মকর্তাদেরও মারধর করা হয়। এতে বেশ কয়েকজন আহতও হয়েছেন। এছাড়া, কারখানার বিভিন্ন মালামাল ভাঙচুর করায় প্রায় পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতিসাধন হয়েছে। একইসঙ্গে, কারখানা থেকে নগদ প্রায় আট লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায় দুষ্কৃতকারীরা।
কোনাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম আশরাফ উদ্দিন জানান, তুসুকার সামনে পুলিশের যানবাহন ভাঙচুরের মামলায় গ্রেপ্তার ২৪ জনকেও তুসুকার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
তিনি আরও জানান, শ্রমিকরা আন্দোলনের নামে বিভিন্ন কারখানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ধ্বংসাত্মক কাজে জড়িয়েছে। এসময় জানমাল, সম্পদ রক্ষায় ও পুলিশ পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গেলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।পুলিশের গাড়িতে ভাঙচুর ও ব্যবহৃত পিকআপে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব ঘটনায় ১০ জনের মতো পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় কোনাবাড়ী থানায় পুলিশ বাদী হয়ে যে ৪টি মামলা দায়ের করেছে, তাতে অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার।
অ্যামেনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের (বিজিআইডব্লিউএফ) গাজীপুর শাখার সভাপতি শহিদুল ইসলাম পোশাকশ্রমিকদের বকেয়া বেতন আদায়ের চেষ্টা করলে হামলায় নিহত হন। একই বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলনের সময় আরও অন্তত চারজন পোশাকশ্রমিক নিহত হন।
পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রাণ গেছে শহিদুলের। হত্যা মামলার তদন্ত তদারক কমিটির প্রধান ও গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইমরান আহম্মেদ জানান, শ্রমিক সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ইন্ধনেই শ্রমিক নেতা শহিদুলকে হত্যা করা হয়েছে। এরইমধ্যে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের ইশারায় অন্য আসামিরা শহিদুলের ওপর হামলা চালায়।
অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের গাজীপুর জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন। তিনি বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি ও পাওনা বেতন আদায় করে দিতে কাজ করতেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করতেন মো. মোস্তফা, আক্কাছ ও শরিফ নামে আরও তিন শ্রমিক নেতা। এর মাঝে বিভিন্ন কারখানায় কমিটি দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁদের সঙ্গে শ্রমিক নেতা মাহাজারুল ও রাসেল মণ্ডলদের বিরোধ বাঁধে। এরপর শহিদুলরা কাজ করতেন নগরের গাছা থানা এলাকায়। মাজাহারুলরা কাজ করতেন টঙ্গীর সাতাইশ এলাকার বিভিন্ন কারখানায়। গত ২৫ জুন শহিদুল ও তাঁর সঙ্গীরা বেতন ও ঈদ বোনাস নিয়ে প্রিন্স জ্যাকার্ড লিমিটেডে শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান করতে যান। বিষয়টি ভালোভাবে নেননি মাজাহারুল ও তাঁর লোকজন।
মে ও জুন মাসের বেতন ও ঈদ বোনাসকে কেন্দ্র করে ২৫ জুন দুপুর থেকে প্রিন্স জ্যাকার্ড কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। খবর পেয়ে বিকেলেই কারখানাটির শ্রমিকদের বেতন আদায় করে দিতে কারখানাটিতে যান শহিদুল, মোস্তফা, আক্কাছ ও শরিফ। বেতন ও বোনাসের বিষয়ে কথাবার্তা বলে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কারখানা থেকে বের হন তাঁরা। এর মাঝেই স্থানীয় প্রভাবশালী মো. আমির হোসেন ও কারখানার মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা মো. সালেহর ‘ইশারায়’ মাজাহারুলেরা শহিদুলদের ওপর চড়াও হন। শহিদুলকে মারধর করেন। এতে শহিদুল গুরুতর আহত হন। তাঁকে গাজীপুরের বোটবাজারে এলাকার তাইরুন নেসা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। অর্থাৎ বেতন বৃদ্ধির দাবি আদায়ের সঙ্গে এই হত্যাকান্ডের সম্পর্ক নেই।