নিত্যপণ্যের দাম যে পরিমাণ বেড়েছে তাতে নিত্যপণ্য বিলাসবহুল পণ্যে পরিণত হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা বড় ধরনের ব্যর্থতা। বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কারণে দেশের অর্থনীতি বর্তমানে বেশ চাপে আছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার দিকে নজর দিতে হবে।
মূল প্রবন্ধে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘মূল্যস্ফীতিতে আমরা ৯ ও ১০ শতাংশে অবস্থান করছি। বর্তমানে তা শ্রীলঙ্কার চেয়েও বেশি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা সরকারের জন্য বড় ধরনের ব্যর্থতা।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনাভাইরাস মহামারিতে অর্থনীতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, পরের বছর কিছুটা কমে এলেও সঙ্গে যোগ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নীতির দুর্বলতা, সুশাসনের অভাব ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যর্থতা। এগুলো ধারাবাহিকভাবে চলেছে। এসব চ্যালেঞ্জ চলতি বছরই নতুন না, আগের বছরও ছিল। এগুলো মোকাবেলা করতেই সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে অর্থনৈতিক সংস্কারে গেছে, ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই সংস্কার কর্মসূচি বড় ধরনের কোনো ফল দেবে, এখন পর্যন্ত তা চোখে পড়েনি।
সরকারের সামনে দুটি পথ রয়েছে, উচ্চ প্রবৃদ্ধি আর সামগ্রিক স্থিতিশীলতা। উচ্চ প্রবৃদ্ধির চেয়ে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা উচিত। নিম্ন প্রবৃদ্ধি নিয়ে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা অর্জন করতে না পারলে দুদিক থেকে ক্ষতি হবে।
ধনী ও গরিবের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মাথাপিছু অভ্যন্তরীণ আয় দুই হাজার ৬৭৫ মার্কিন ডলার, আর মাথাপিছু জাতীয় আয় দুই হাজার ৭৮৪ ডলার। মাথাপিছু গড় আয় যতটুকু পেয়েছি, মূলত উচ্চ আয় করেন তাঁদের কারণে। গরিব মানুষদের কথা বিবেচনা করলে তাদের আয় কমে গেছে। এখানে বৈষম্য বেড়েছে। তাদের উন্নতি হয়নি। বেসরকারি বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে না। সরকারের অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া একটি বড় কারণ। বিষয়টি সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারের ৭.৫ শতাংশ বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে মনে করছি।’
তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৭.৫ শতাংশ। কিন্তু জানুয়ারিতে তা সংশোধন করে ৬.৫ শতাংশ করা হয়েছে। আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তা আরো কম প্রাক্কলন করেছে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে রয়েছে সরকার। জিডিপির বৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের ধারাটি বাড়ছে না, বরং কমছে। জিডিপিতে জাতীয় আয় বাড়ছে, কিন্তু কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখতে পারছে না বা কম সহায়তা করছে। যতটুকু কর্মসংস্থান হচ্ছে তা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে বাড়ছে, যা আসলে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ওই কর্মসংস্থানে মজুরি ও নিরাপত্তার হুমকি রয়েছে।
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রসঙ্গে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ের ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি, যা গত বছরের জুলাই-জানুয়ারি হিসেবে ভালো অবস্থানে রয়েছে। গত বছর নেতিবাচক ছিল। সেখান থেকে ইতিবাচক ধারায় ফিরে এসেছি, এটা ভালো দিক। যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হয়, তাহলে ৬৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। অন্যদিকে এনবিআরের ক্ষেত্রে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬.৫ শতাংশ। আয়ের বড় অংশ হচ্ছে ভ্যাট ও শুল্ক থেকে। অভ্যন্তরীণ মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বেড়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থানের কারণে আমদানি শুল্ক কমেছে। এত কিছুর পর আইএমএফের নির্দেশনা অনুসরণ করে সরকার যে রাজস্ব বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা কঠিন বলে মনে করছি।’
তিনি বলেন, বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে সরকার অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ সুদে ঋণ নিচ্ছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিচ্ছে, ফলে তা দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিশোধে রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। এটা ভবিষ্যৎ মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে কর ফাঁকি ও কর এড়িয়ে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। কর কাঠামোকে ডিজিটাইজড করতে হবে এবং অর্থপাচার বন্ধ করার দিকে নজর দিতে হবে।
সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকারের প্রাধিকার প্রকল্প জনবান্ধব হতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের জন্য গাড়ি কেনা ও বিদেশভ্রমণ বন্ধ করতে হবে। এই মুহূর্তে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের বিকল্প নেই।