দেশের নদ-নদী ও পরিবেশ রক্ষায় সরকার শতবর্ষী ডেল্টা প্লান-২১০০ বাস্তবায়নে পঞ্চগড় জেলায় ৫টি নদী ও ১টি খাল খনন করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পানি সম্পদের সুষম বন্টন ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনগণের জীবন-জীবিকার জন্য পানির চাহিদা পূরণ এবং টেকসই উন্নয়ন, পুনঃখননের মাধ্যমে ছোট নদী, খাল ও জলাশয়গুলো পুনরুজ্জীবিত করা, ছোট নদী, খাল এবং জলাশয়ের পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করা, নদীতে পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে মৎস্য চাষের উন্নয়ন করা, নদীগুলোর উভয় তীরে বনায়ন করা, খননকৃত মাটি উভয় তীরের ভূমি উন্নয়ন, পরিবেশ ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন করার লক্ষে এসব নদী ও খাল খনন করা হয়েছে। ফলে শত শত হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা পাচ্ছে কৃষকেরা। এই কারণে নদী ও প্রকৃতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। খাল খননের পরেই উভয় পাড়ের নতুন মাটিতে বিভিন্ন প্রকারের ৯ হাজার গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। যার কারণে পরিবেশের ভারসম্য রক্ষার পাশাপাশি গাছপালাগুলো এখন শোভা বর্ধন করছে।
পঞ্চগড়ে নদী খনন বাস্তবায়নের ফলে ছোট নদী, খাল এবং জলাশয়গুলোতে পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বছর ব্যাপী সেচ সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব হবে। পুনঃখননে এই নদী-খাল ও জলাশয় গুলো যেন জীবন ফিরে পেয়েছে। ফলে মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধি এবং জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহজতর এবং নদী ও জলাশয়ের তীরে বনায়ন করার ফলে পরিবেশ ও আর্থ সামাজিক অবস্থা উন্নয়ন সম্ভব হবে। ভূমি উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার সহ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতির পাশা-পাশি বন্যা প্রবণতা হ্রাসপাবে এবং এলাকাবাসী বহুমাত্রিক ব্যবহার ও সুবিধার আওতায় এসে উপকৃত হবে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, মৃতপ্রায় নদীগুলোর প্রাণ ফেরাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬৪ জেলার ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড়ের ৫টি নদী ও ১ খাল পুনঃখনন হাতে নেয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৪টি নদী ও ১ খাল পুনঃখনন কাজ সমাপ্ত হয়েছে।
পঞ্চগড়ের মীরগড় থেকে দিনাজপুর খানসামা পর্যন্ত ৭৮ কি.মি. করতোয়া নদীর ড্রেজিংয়ের কাজ চলমান রয়েছে। এই কাজ শেষ হলে মৃত প্রায় করতোয়া নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সারা বছর পানির প্রবাহ বজায় থাকবে। সদর উপজেলার চাওয়াই নদী ২০ কিলোমিটার, তেঁতুলিয়ার ভেরসা নদীর ১০ কিলোমিটার, দেবীগঞ্জ উপজেলার বুড়িতিস্তার ২০ কিলোমিটার, বোদার উপজেলার পাথরাজ নদী ৩০ কিলোমিটার এবং আটোয়ারী উপজেলার বড়সিংগিয়া খালের ৬ কিলোমিটার পুনঃখনন শেষ হয়েছে। পুনঃখননের পর নদীগুলো ফিরে পেয়েছে প্রাণ।
নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি ফলে পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী মানুষ বর্ষার মৌসুমে ভাঙনের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। আর নদী কেন্দ্রীক জীব বৈচিত্র্য পেয়েছে নতুন ছন্দ। এখন শুকনো মৌসুমেও এসব নদীতে মিলছে পানি। নদীর উভয় পাড়কে সুরক্ষিত এবং লোক চলাচলের ব্যবস্থা করাও হয়েছে। এতে নদীর সৌন্দর্য্য বেড়েছে। জলে মিলছে নানা প্রজাতির মাছ আর জলজ উদ্ভিদ। ১২ মাস সেচসুবিধা পাওয়ায় নদীর তীরবর্তী কৃষি জমিগুলো ফসলে ভরে গেছে।
ভাউলাগঞ্জ এলাকার জুয়েল মণ্ডল বলেন, বুড়িতিস্তা নদীটি খনন করায় গভীরতা যেমন বেড়েছে তেমনি শুকনো মৌসুমেও পানি মিলছে। সরকারের মহৎ উদ্যোগের কারণে নদীগুলো যেমন প্রাণ ফিরে পাচ্ছে তেমনি পরিবেশের ভারসম্য রক্ষা হচ্ছে।
কাজলদিঘী কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলাউদ্দীন আলাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগে কোনো সরকার প্রধান নদীগুলো বাঁচাতে কোন উদ্যোগ নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী নদী ও পরিবেশ বাঁচাতে ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০ হাতে নিয়েছেন। নদীগুলো পুনঃখনন করে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে। এছাড়া নদী দখল মুক্ত করতে চালানো হচ্ছে অভিযান।
আটোয়ারীর বড়সিংগিয়া এলাকার মাহাতাব উদ্দিন বলেন, খালটি পুনঃখনন করায় আমাদের অনেক উপকার হয়েছে। আগে আমাদের জমিগুলো বর্ষাকালে পানিতে ডুবে থাকতো। পানি বের হওয়ার পথ ছিলো না। এখন খালটি পুনঃখনন করে দেয়ায় পানি সরে যাওয়ার পথ তৈরি হয়েছে। এখন আমরা অনেক ধরণের ফসল ফলাতে পারছি।
তেঁতুলিয়ার ভজনপুর বামনপাড়া এলাকার বশিরউদ্দিন বলেন, আগে নদীতে বেশিরভাগ সময় কোনো পানি থাকতো না। এখন নদীতে বারো মাস পানি থাকে। এতে মাছ যেমন বেড়েছে তেমনি নদীর পানি নিয়ে আমরা বিভিন্ন ফসল চাষ করছি।
পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোঃ মোছান্না গালিব জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড় জেলায় ১৬৪ কি.মি. নদীপুনঃখনন কাজ বাস্তবায়ন করা হবে। এজন্য প্রায় ১৪৯ কোটি টাকা ব্যয় হবে। ইতিমধ্যেই ১৬.৪৫ কোটি টাকা ব্যায়ে ভেরসা নদীর ১০ কি.মি. চাওয়াই নদীর ২০ কি.মি. বুড়িতিস্তা নদীর ২০ কি.মি. পাথরাজ নদীর ৩০ কি.মি. এবং আটোয়ারী উপজেলার বড় শিংগীয়া খালের ০৬ কি.মি.সহ ৬৬ কি.মি. খনন করা হয়েছে। পঞ্চগড়ের অধিকাংশ নদীই স্যাণ্ডিসয়েল বালি মাটি। যার কারণে বালু আবার নদীতে গিয়ে পরে। বেশীরভাগ নদী পাহাড়ী ঢল থেকে উৎপন্ন। নদীগুলোর গ্র্যাডিয়েন্ট ঢালুতা অনেক বেশি, তাই সীলট্রেশনের হারও বেশী। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী সুফল পেতে হলে নদীগুলোকে পর্যায়ক্রমে পুনঃখনন কাজ চলমান রাখতে হবে।
তিনি আরো বলেন, ডেল্টাপ্লান ২০২১ বাস্তবায়ন সফলভাবে সম্পন্ন হলে, ছোট নদী, খাল এবং জলাশয় গুলোতে পানি প্রবাহবৃদ্ধি, বছরব্যাপী সেচ সুবিধার ফলে কৃষি উৎপাদন ও মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধি এবং জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ এই প্রকল্প দেশের জলবায়ু মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো শাহনেওয়াজ সিরাজী বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ৫টি নদী ও ১টি খাল পুনঃখননের কাজ প্রায় শেষের দিকে। ফলে নদী গুলোতে সারা বছর পানি থাকছে। এসব নদী ও খালে মৎস চাষ করা হলে মাছের অভয়ারন্য হবে। একদিকে স্থানীয়দের যেমন আমিষের চাহিদা পূরন হবে, পাশাপাশি দেশের মৎস সম্পদ রপ্তানিতে সহায়ক হবে বলে মনে করছি। এ জন্য আমরা সরকারের কাছে মৎস চাষের জন্য আবেদন করবো। যাতে এসব নদীতে মাছের অভয়াশ্রম তৈরি হয়।