চাকরিতে ঢোকার বয়স বাড়ালে লাভ-ক্ষতি কী হবে

Shakil Shahriar
মে ৮, ২০২৪ ৯:০৯ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি চাকরিতে ঢোকার বয়স ৩০ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩৫ করার দাবি বাড়ানোর দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছে। এই দাবির সাথে একমত পোষণ করে ধরে শিক্ষামন্ত্রী সুপারিশ করেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। এতেই চাঙ্গা হয়ে ওঠেছে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়লে, বেকার সমস্যা সমাধান হবে, নাকি বেকারের তালিকা আরও বড় হবে- তা বিশ্লেষণের দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত ২৯ এপ্রিল সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি দেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। শিক্ষামন্ত্রীর ওই প্রস্তাব পেয়েছেন জানিয়ে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, এটি রাষ্ট্রের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ প্রস্তাব উপস্থাপিত হওয়ার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। তিনিই সিদ্ধান্ত দেবেন।

চাকরিপ্রার্থী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর। বয়স নয়, যোগ্যতাই এখানে বিবেচ্য হওয়া উচিৎ। বাংলাদেশে ৩৩ বছর আগে ১৯৯১ সালে বয়সসীমা ২৭ বছর থেকে ৩০ বছর করা হয়। যখন গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর। গড় আয়ু বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে। কিন্তু চাকরির আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা বাড়েনি।

সাধারণ শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদের মুখপাত্র শরিফুল হাসান শুভ বলেন, বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ২৪-২৫ বছর বয়সে স্নাতক শেষ করে বের হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক শেষ করতে ২৭-২৮ বছর বয়স হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া অনেকে অসুস্থতাজনিত কারণে সময় মতো পড়ালেখা শেষ করতে পারেন না।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোয় কোনও অসুবিধা দেখছেন না সরকারি কর্ম কমিশন-পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ। তিনি সেইসঙ্গে অবসরের বয়সও বাড়ানোর পক্ষপাতি।

তিনি বলেন, “সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি বহু দিনের। অনেকেই সময়মতো পড়ালেখা শেষ করতে পারে না। আবার অনেক সময় সরকারি চাকরির পরীক্ষায়ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকের বয়স বেশি হয়ে যায়। ফলে বয়সসীমা বাড়লে আমি কোনও অসুবিধা দেখি না। তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এখন অবসরে যাওয়ার বয়স বাড়ানোর সময় এসেছে। এখন দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ফলে কোনও চাকরিজীবী যদি সুস্থ থাকে, তাহলে তাকে আরও বেশি সময় চাকরিতে রাখা যেতে পারে। অন্যান্য অনেক দেশেই এখন অবসরের বয়স বেড়েছে।”

চাকরির বয়স বাড়ালেই বেকার সমস্যার সমাধান আসবে, তেমনটা মনে করেন না ব্র্যাকের মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, ‘একজন ব্যক্তি ৩০ বছরের মধ্যে চাকরিতে প্রবেশ করলে একজন প্রার্থী অপেক্ষাকৃত তরুণ থাকে এবং প্রশিক্ষণসহ নানা ধরনের কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে তার যতটা আগ্রহ থাকবে, ৩৫ বছরের বেশি বয়সের প্রার্থীর ততটা আগ্রহ থাকবে না।’ তারুণ্যের শক্তির অপচয় রোধে বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে উপযুক্ত সুবিধা ও চাকরির নিশ্চয়তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, ‘‌জন্মহার কমে যাওয়ায় দেশের তরুণ জনশক্তি কমে যাচ্ছে। এটা ক্রমাগত কমে আসবে। ২০৩৫-৩৬ সালের মধ্যে যুবকদের তুলনায় নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বেশি হবে। আর তরুণদের ৩০ শতাংশ আবার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মে নেই। নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও আমরা তাদের কোনো কিছুতে যুক্ত করতে পারিনি। ধীরে ধীরে যুবকের সংখ্যা কমে বেকারের চাপও কমে আসবে। বয়স্ক মানুষ বাড়বে। তাই কর্মক্ষম ও অভিজ্ঞদের কাজে লাগাতে অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯ থেকে বাড়িয়ে ৬২ বছর করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এটি যুক্ত করা যায়।’

পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪-৫ লাখ শিক্ষার্থী পড়ালেখা শেষ করে চাকরির বাজারে আসে। যেখানে প্রতিবছর সরকারি চাকরিতে কর্মসংস্থান হয় ৪-৫ হাজার প্রার্থীর। এছাড়া সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে আরও ২-৩ হাজার কর্মসংস্থান হয়। এ ধরনের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর। এরপর আর সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করার সুযোগ থাকে না।

অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, উপজাতি কোটা থেকে যারা সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করে, তাদের জন্য বয়সের ঊর্ধ্বসীমা ৩২ বছর। সেবিকার চাকরির ক্ষেত্রে তা ৩৬ বছর এবং বিভাগীয় প্রার্থীর কোটায় ৩৫ বছর।

দেশে সরকারি চাকরির বয়স নির্ধারণের বিষয়টি শুরু হয় ব্রিটিশ ভারতে। তখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ছিল ২৩ বছর। পাকিস্তান শাসনামলে এই সীমা বাড়িয়ে ২৫ বছর করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর এই বয়স আরও দুই বছর বাড়ানো হয়। এরশাদের শাসনামলে এই বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়।

ভারতে সরকারি চাকরিতে আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ থেকে ৪৫ বছর। কাতার, তাইওয়ান, ইতালিতে ৩৫ বছর। ফ্রান্সে ৪০ বছর। শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়ায় ৪৫ বছর। সুইডেন ও কানাডায় ৪৭ বছর। আর যুক্তরাষ্ট্রে ৫৯ বছর।