সরকারি গাড়ি ব্যবহারে লগবই সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক

admin
এপ্রিল ২৬, ২০২১ ১০:০৭ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

৪০ বছর আগের সার্কুলার কার্যকর করার তাগিদ দিয়ে চিঠি ইস্যু করল পরিবহণ পুল
সরকারি গাড়ির নানামুখী অপব্যবহার দূর করতে ৪০ বছর আগে প্রণীত লগবই ব্যবস্থাপনায় ফিরছে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর (পরিবহণ পুল)। লগবই সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করে সম্প্রতি এ বিষয়ে অফিস আদেশ জারি করেছে সরকারি পরিবহণ নিয়ন্ত্রণকারী এ কর্তৃপক্ষ, যা সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে অবহিত করা হয়েছে। তবে চিঠি ইস্যুর ১৫ দিন পার হয়ে গেলেও এখনো তা কার্যকর হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার্কুলার অনুযায়ী গাড়িতে জ্বালানি ব্যবহার ও চালকদের ডিউটির বিষয়ে লগবইয়ে রেকর্ড রাখা বাধ্যতামূলক করা হলে গাড়ির অপব্যবহার অনেকাংশে কমে আসবে। বিশেষ করে যেসব কর্মকর্তা গাড়ি নগদায়নের সুযোগ নিয়ে সরকারি তহবিল থেকে সুদমুক্ত ৩০ লাখ টাকার ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছেন তাদের গাড়ি অপব্যবহার কমে আসবে। পাশাপাশি চালকরাও ডিউটি না-করে অধিকাল কিংবা অতিরিক্ত খাটুনি ভাতা নিতে পারবেন না।
সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিচালক সড়ক (যুগ্ম সচিব) মোহাম্মদ মাহবুব শাহীন রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘যেহেতু লগবই চালু করার বিষয়ে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে সেহেতু আমরা ধরে নেব, এটি ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। তবে যথাযথভাবে মানা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে মনিটরিং করা হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভালো কোনো উদ্যোগ শুরু করলে প্রথমেই শতভাগ বাস্তবায়ন করা যায় না। তবে পরিবহণ পুল কর্তৃপক্ষ আশা করে, সরকারি স্বার্থ সুরক্ষায় সংশ্লিষ্টরা এ নির্দেশনা দ্রুত বাস্তবায়নে সক্রিয় হবেন।
সূত্র জানায়, পরিবহণ পুল থেকে গত ৭ এপ্রিল এ সংক্রান্ত চিঠি ইস্যু করা হয়। এতে বলা হয়, পরিবহণ পুলের গাড়ি চালকরা পদায়ন ও সংযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অধিদপ্তরে মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রশাসনিক ডিউটিতে নিয়োজিত আছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে লগবইয়ে জ্বালানি ব্যবহার ও চালকের ডিউটির সময়সীমা যথাযথভাবে সংরক্ষণ বা রেকর্ড না-থাকায় গাড়ি চালকদের অতিরিক্ত খাটুনি ভাতার বিষয়ে প্রতি অর্থবছরে অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়ে থাকে। তা ছাড়া অধিকাল ভাতা প্রদানে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় ১৯৮০ সালের ২৯ এপ্রিল তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয় (বর্তমানে জনপ্রশাসন) থেকে জারি-করা এ সংক্রান্ত সার্কুলার প্রতিপালন করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়।
সার্কুলারটিতে গাড়ি চালকদের অধিকাল ভাতার বিষয়ে তিন দফা নির্দেশনা দেওয়া আছে। ওইসময় সাপ্তাহিক সরকারি ছুটি ছিল রোববার। তাই সার্কুলারের প্রথম নির্দেশনায় বলা আছে, চালকরা রোববার সাপ্তাহিক ছুটি ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনসহ ঘণ্টাপ্রতি মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ হিসাব করে অধিকাল ভাতা পাবেন। তবে তা ২৫০ ঘণ্টা অথবা মাসিক মূল বেতনকে অতিক্রম করবে না। এরপর বলা আছে, ৮ ঘণ্টা ডিউটির বাইরে অতিরিক্ত ডিউটির সময়কালকে প্রতি ঘণ্টা হিসাব করে যথাযথভাবে লগবইয়ে লিপিবদ্ধ করতে হবে। এই হিসাবের ওপর ভিত্তি করে মাস শেষে বেতনের সঙ্গে তার অধিকাল ভাতার বিল প্রস্তুত করতে হবে।
সূত্র জানায়, গত বছর কোভিড-১৯ বা মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় তিন মাস অফিস বন্ধ ছিল। ওই সময়ে পরিবহণ পুলের চালকদের অনুকূলে তাদের মূল বেতনের সমপরিমাণ অধিকাল ভাতা প্রদান করা হয়। তবে গত মার্চে এ বিষয়ে একজন আইনজীবী এই অধিকাল ভাতা প্রদানকে বেআইনি উল্লেখ করে আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন। যেখানে ওই আইনজীবীর মূল বক্তব্য ছিল, কোভিডের সময় যেখানে সরকারি অফিস বন্ধ ছিল, সেখানে চালকদের এভাবে অতিরিক্ত ডিউটি ভাতা দেওয়ার আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। আদালত এ বিষয়ে ৯০ দিন সময় দিয়ে জনপ্রশাসন সচিব, যোগাযোগ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর সচিব, অর্থ সচিব, পরিবহণ কমিশনার ও এজি অফিসের প্রধান হিসাব কর্মকর্তাকে জবাব দেওয়ার জন্য রুল দিয়েছেন। এরপর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে এবং মহলবিশেষ থেকে পরিবহণ পুলের গাড়ি চালকদের অধিকাল ভাতা প্রদানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। মূলত এই প্রেক্ষাপটে ৭ এপ্রিল পরিবহণ পুল থেকে লগবই সংরক্ষণের বিষয়ে চিঠি ইস্যু করা হয়।
এদিকে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবহণ পুলের কয়েকজন গাড়িচালক যুগান্তরকে বলেন, করোনাকালীন তাদের অধিকাল ভাতা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছেন তারা মূলত অন্ধকারে আছেন। সঠিক তথ্য তাদের কাছে নেই। কারণ, ওই সময় সরকারি অফিস বন্ধ থাকলেও পরিবহণ পুলের অন্তত ৪০ জন চালককে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন কোভিড হাসপাতাল ছাড়াও স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, ত্রাণ মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রাতদিন ডিউটি করতে হয়েছে। রিকুইজিশন দিয়ে তাদেরকে নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকে জরুরি কাজের প্রয়োজনে কল করলেই তাদের ডিউটিতে যেতে হয়েছে। নির্দেশনা দিয়ে পরিবহণ পুলের সব ড্রাইভারকে নিজ নিজ কর্মস্থলে স্ট্যান্ডবাই থাকতে বলা হয়েছিল। অর্থাৎ, আইন অনুযায়ী তারা সবাই ওই সময় অনডিউটিতে ছিলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ‘আমরাও চাই লগবই যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হোক। কিন্তু প্রশাসনিক ডিউটিতে থাকা লাইনের গাড়ি ছাড়া আর কোনো গাড়িতে এখনো লগবই চালু হয়নি।’ তারা বলেন, ‘আমরা অধিকাল ভাতা চাই না। বরং ওভারটাইম দেওয়া হোক। সরকারি অনেক দপ্তরে ওভারটাইম চালু আছে। এমনকি পরিবহণ পুলের ওয়ার্কশপে ওভারটাইম দেওয়া হয়। ২৫০ ঘণ্টাও দরকার নেই। কমিয়ে দেওয়া হোক। ওভারটাইম দিলে অতিরিক্ত ডিউটির বিপরীতে তারা দ্বিগুণ ভাতা পাবেন।’
সচিবালয়ে কর্মরত প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার এবং দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের অনেকে যুগান্তরকে বলেন, যেসব ক্যাডার কর্মকর্তা গাড়ি নগদায়ন করে সরকারি তহবিল থেকে ৩০ লাখ টাকা নিয়ে গাড়ি কিনেছেন তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেন। বাস্তবতা হলো, বেশিরভাগ কর্মকর্তা সরকারি বিশেষ সুবিধায় কেনা গাড়ির বিপরীতে মাসে ৫০ হাজার টাকা অতিরিক্ত ভাতা নিলেও ব্যবহার করেন পরিবহণ পুল ও প্রকল্পের গাড়ি, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। তবে আশার কথা, চালকদের ভাতা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে লগবই ব্যবস্থা চালু করতে গিয়ে তাদেরও জবাবদিহির ফাঁদে পড়তে হবে। কারণ, লগবইয়ে গাড়ি ব্যবহারকারী কর্মকর্তাকে স্বাক্ষর করতে হবে। তখন সব গোমর ফাঁস হয়ে যাবে। যদিও এটি যথাযথভাবে কার্যকর হওয়া নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।