ফ্লাইট ছাড়ার আগ মুহূর্তে মিলেছে করোনা রিপোর্টও
ছুটিতে দেশে এসে আটকেপড়া প্রবাসী কর্মীরা কয়েকদিনের অনিশ্চিত অপেক্ষা এবং বিক্ষোভের পর কর্মস্থলে ফেরার বিমান টিকিট পেয়েও শেষ বেলায় ভুগেছেন করোনা পরীক্ষার ফল পেতে। গতকাল শুক্রবার মধ্যরাতে সৌদি আরবের জেদ্দাগামী ফ্লাইটে দেশ ছাড়া ২৬০ কর্মীর অনেকেই রিপোর্ট পেয়েছেন বিমানবন্দরে প্রবেশের ঘণ্টাখানেক আগে।
বিদেশগামীদের করোনা পরীক্ষায় মহাখালীর ডিএনসিসি মার্কেটে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র থেকে রাত পৌনে ৮টায় ফল হাতে পান পাবনার আমিরুল ইসলাম। রিপোর্ট পেয়েই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। তিনি জানান, বিমান ধরতে হলে আর ৪৫ মিনিটের মধ্যে তাকে বিমানবন্দরে পৌঁছাতে হবে। এরপর বোর্ডিং পাস নিয়ে ইমিগ্রেশনের জন্য দাঁড়াবেন। রাত সোয়া ১২টায় সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটের যাত্রী তিনি।
বৃহস্পতিবার বিকেলে টিকিট হাতে পেয়ে শুক্রবার সকাল ১০টায় করোনার নমুনা দেন আমিরুল ইসলাম। একই অবস্থা চট্টগ্রামের সৈয়দ কালামের। তিনিও রাত পৌনে ৮টায় করোনা রিপোর্ট পান। তারা জানান, আগের দিন টিকিট পেলেও নমুনা সংগ্রহের বুথ বিকেল ৫টায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরীক্ষা করাতে পারেননি।
রাত ৯টার দিকেও কয়েকজন প্রবাসী কর্মীর করোনার পরীক্ষার ফল ইমিগ্রেশনের সার্ভারে দেখাচ্ছিল না। তাদের হাতে কাগজের ছাপা ফল থাকলেও সার্ভারে না দেখানোর কারণে তাদের ইমিগ্রেশন পার হতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। রাত সোয়া ৯টার দিকে বোর্ডিং পাসের জন্য অপেক্ষমাণ তিন কর্মী করোনা পরীক্ষার ফল এসএমএসের মাধ্যমে পান।
বিল্লাল হোসেনের ফ্লাইট আজ শনিবার বিকেল ৬টায়। শুক্রবার তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টিকিট পান। কিন্তু জানতেন না কোথায় করোনা পরীক্ষা করাতে হবে। গতকাল রাত ৮টার দিকে তিনি কাঁদতে কাঁদতে আসেন ডিএনসিসি মার্কেটের বুথে। তাকে দায়িত্বরত সেনা সদস্যরা সকাল ৬টায় আসতে বলেন। জানানো হয়, সকালে নমুনা দিলে দুপুর ১টার দিকে পরীক্ষার ফল পাবেন।
চার ঘণ্টার মধ্যে ফল পাওয়ার কথা থাকলেও গতকাল সকালে নমুনা দেওয়া কর্মীরা ফল পান ১০ ঘণ্টা পর। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, গতকাল মহাখালীতে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল না। বৃহস্পতিবার যারা বিকেল ৫টার পর এসেছিলেন তাদের নমুনা নেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুথ। এতে অবশ্য কর্মীদের দোষ ছিল না। যদিও বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত টিকিট দিয়েছে এয়ারলাইনগুলো।
ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. মইনুল আহসান সমকালকে বলেছেন, যারা বৃহস্পতি ও শুক্রবার নমুনা দিয়েছেন, তাদের সবার ফল দেওয়া হয়েছে। যাদের করোনা নেগেটিভ এসেছে তারা বিমানে উঠবেন। যাদের পজিটিভ আসবে তাদের জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পজিটিভের সংখ্যা প্রকাশ করা হবে না।
করোনার কারণে স্বাভাবিক বিমান যোগাযোগ দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। ছুটিতে দেশে এসে আটকা পড়েছেন প্রায় দুই লাখ প্রবাসী কর্মী। তাদের মধ্যে প্রায় ৮০ হাজার সৌদিপ্রবাসী ফিরতি টিকিট নিয়ে দেশে এসেছেন। কিন্তু করোনায় আটকে যান। তিন দফায় সাত মাস তাদের ভিসা ও আকামার মেয়াদ বাড়ায় সৌদি সরকার। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হবে এ মেয়াদ। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আকামার মেয়াদ ২৪ দিন বাড়িয়েছে সৌদি। ভিসা ও কাজে ফেরার সময়সীমা (এক্সিট রি-অ্যান্ট্রি) বাড়াতে সম্মত হয়েছে রিয়াদ।
তবে সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনও এ বিষয়ে লিখিত কোনো ঘোষণা আসেনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গতকালও বলেছেন, দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ছুটিতে এসে আটকেপড়া সবাই সৌদি আরব যেতে পারবেন। এ জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। কারও ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও আকামা থাকলে তাদের আবার ভিসা দেওয়া হবে।
তবে সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লিখিত ঘোষণা না আসায় কর্মীরা এখনও অনিশ্চয়তা ভুগছেন। এ অনিশ্চয়তা থেকেই গত শনিবার থেকে কর্মস্থলে ফেরার টিকিটের জন্য বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের অফিসে ভিড় করেন তারা। সড়ক অবরোধ, মন্ত্রণালয়ের সামনে বিক্ষোভও করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সৌদিতে ছুটি চলছে। রোববার অফিস খোলার পর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে।
বিক্ষোভ প্রদর্শন ও টিকিটের তুলনায় যাত্রীসংখ্যা কয়েকশ’ গুণ হওয়ায় টিকিট বিক্রি বন্ধ ছিল দু’দিন। বৃহস্পতিবার আবার চালু হয়। যারা আগে টোকেন নিয়েছিলেন তারা গতকালও টিকিট পেয়েছেন সোনারগাঁও হোটেলে সৌদিয়ার কার্যালয় থেকে। কারওয়ান বাজারে গতকালও ছিল কর্মীদের ভিড়।
শুক্রবার সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সের কাউন্টার থেকে ৫০১ থেকে ৮৫০ নম্বর টোকেনধারী ৩৫০ জনের সৌদি ফেরার টিকিট নিশ্চিত করা হয়। এদিন যারাই টিকিট পেয়েছেন, তাদের গন্তব্য ছিল মহাখালী ডিএনসিসি মার্কেটের করোনা পরীক্ষাকেন্দ্রে। আজ ৮৫১ থেকে ১২০০ নম্বর টোকেনধারীদের ফেরার টিকিট দেওয়া হবে। রোববার ১২০১ থেকে ১৫০০ নম্বর টোকেনধারীদের টিকিট দেওয়া হবে। যারা টোকেন পাননি, তাদের ২৯ সেপ্টেম্বর আসতে বলা হয়েছে। এই সময় পর্যন্ত সৌদি আরব যেতে নতুন টিকিট বিক্রি করা হবে না।
ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়াতে সৌদি এয়ারলাইন্স কোনো আবেদন করেনি বলে জানান বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান। সংস্থাটি চলতি মাসে ঢাকা থেকে চারটি ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পেয়েছিল। আর কোনো ফ্লাইটের আবেদন করেনি সৌদি এয়ারলাইন্স।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও সৌদি প্রবাসীদের ফিরতি টিকিট ইস্যু করছে। গতকাল রি-ইস্যু করা হয় ১৮ ও ২০ মার্চের জেদ্দা এবং ১৮ ও ১৯ মার্চের রিয়াদগামী ফ্লাইটের টিকিট।
যারা ফিরতি টিকিট পেয়েছেন, করোনা পরীক্ষা নিয়ে তাদের ভোগান্তি হলেও কর্মস্থলে ফিরতে পারছেন। কিন্তু যারা এখনও টোকেনই পাননি তারা আছেন চরম অনিশ্চয়তায়। সৌদি কর্তৃপক্ষের বরাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভিসা ও আকামার মেয়াদ বৃদ্ধির আশ্বাস দিলেও কর্মীরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তাদের একজন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার আবুল বাশার। তিনি গতকাল এসেছিলেন সৌদিয়ার কার্যালয়ে। কিন্তু সোনারগাঁও হোটেলের ফটকের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি।
আবুল বাশার সৌদি আরবে বাসাবাড়িতে দারোয়ানের চাকরি করেন। উদ্বিগ্ন এই কর্মী জানান, নিয়োগকর্তার (কফিল) সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ফিরতে না পারলে চাকরি নেই। আবুল বাশার জানালেন, সৌদি সরকার রোববারের মধ্যে ভিসার মেয়াদ না বাড়ালে তার আর কর্মস্থলে ফেরা হবে না। আবুল বাশারের মতো শত শত কর্মী গতকালও টিকিটের আশায় ঘুরেছেন।
তবে ফিরতি টিকিট না পাওয়াদের মধ্যে কয়েকজন সৌভাগ্যবানও রয়েছেন। যাদের ‘কর্মীবান্ধব’ কফিল ছুটির মেয়াদ আর কর্মস্থলে ফেরার সময়সীমা বাড়িয়ে দিয়েছেন। কুমিল্লার কসবার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ তেমন একজন। তিনি জানালেন, নিয়োগকর্তা তার ছুটি ১১ নভেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর জন্য কফিলকে ৩৫০ রিয়াল (আট হাজার টাকা) দিতে হয়েছে।