• পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন ভবন
রহিম শেখ ॥ করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে কয়েকটি ‘মেগা প্রকল্পের’ অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হলেও রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পের নির্মাণ কাজ এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মাণ করা হচ্ছে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংবলিত এই পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র। প্রায় এক লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের এ প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে বিদেশী জনবলও বৃদ্ধি করা হয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে আবাসন প্রকল্প। পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর গ্রামে নির্মিত হয়েছে বিশ্বমানের ‘গ্রীন সিটি’। এই গ্রীন সিটিতে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন সব আধুনিক ভবন। কিন্তু ভবনের মালামাল ক্রয়ে দুর্নীতি ও অপচয়ের অভিযোগে শতভাগ সম্পন্ন করা যায়নি আবাসন প্রকল্পের কাজ। এজন্য আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর ছাড়াই নির্মিত ভবনগুলোতে বসবাস শুরু করেছেন রাশিয়ান বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বমানের অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয় প্রচলিত ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা হয়না। যে আবাসন তৈরি হচ্ছে বিদেশীদের বসবাসের জন্য সেখানে তুলনামূলকভাবে অনেক ভাল উপকরণ ব্যবহার ও সরবরাহ না করলেও বসবাস করা কষ্টকর হবে।
১৯৬১ সালে পদ্মার তীরে পাবনার রূপপুরে এই পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা প্রকল্পের চেহারা নিতে অর্ধশতক পার হয়ে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ প্রকল্পে গতি আসে; চুক্তি হয় রাশিয়ার সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের অক্টোবরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের ভিত্তিস্থাপন করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর রোসাটমের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশন। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড ব্যয়ের এই প্রকল্পে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ৩০ নবেম্বর বিদ্যুত কেন্দ্রের ঢালাই কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার আশা করছে, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিটের বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে দেয়া সম্ভব হবে। পরের বছর চালু হবে সমান ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিট।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, রূপপুর প্রকল্প এলাকায় এক হাজার ৬২ একর জমির ওপর চলছে বিপুল কর্মযজ্ঞ। রুশ সহায়তায় এ প্রকল্পে দুই ইউনিট মিলিয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার (১ লাখ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা)। আট হাজারের মতো জনবল এখন এ প্রকল্পে কাজ করছে, যার মধ্যে ১৮০০ জন রাশিয়ানসহ বিদেশী জনবল রয়েছে প্রায় তিন হাজার। বিদ্যুত কেন্দ্রের রাশিয়ান কর্মকর্তাদের বসবাসের আবাসন প্রকল্প গ্রীন সিটির কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জুলাই মাসে। ৩৬ দশমিক ১১ একর জমিতে গ্রীন সিটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই গ্রীন সিটি বাস্তবায়নে রয়েছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ও গণপূর্ত অধিদফতর।
মাস্টার প্লান অনুযায়ী, আবাসনের জন্য মোট ২১টি বহুতল বিশিষ্ট ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। এগুলোর মধ্যে ২০তলা বিশিষ্ট ১২টি, ১৬তলা বিশিষ্ট ৭টি এবং ১৫তলা বিশিষ্ট ২টি ভবন রয়েছে। ১৫তলার দুটি ভবনে ১৫০০ বর্গফুটের ফ্লাট থাকছে। ১২৫০ বর্গফুটের ফ্লাটের ১৬টি এবং ৮৫০ বর্গফুটের ফ্লাটের ২০তলা বিশিষ্ট ৩টি ভবন রয়েছে। ডরমেটরি কাম মাল্টিপারপাস কমার্শিয়াল ২০তলা ১টি ভবন নির্মাণের টেন্ডার ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। ফায়ার স্টেশন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ও সোয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্টও গ্রীন সিটিতে থাকছে। এছাড়াও গ্রীন সিটিতে ১টি দোতালা মসজিদ ভবন, ছয় তলা বিশিষ্ট স্কুল ভবন, দ্বিতল সাব-স্টেশন, জেনারেটর, পাম্প হাউস ভবন, খেলার মাঠ, গেস্ট হাউস এবং ফোয়ারা নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে। এ পর্যন্ত দশটি আবাসিক ভবনের কাজ সম্পূর্ণ শেষ হয়েছে। রূপপুরের আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সম্পূর্ণ শেষ হওয়া ২০তলা বিশিষ্ট ৬টি এবং ১৬তলা বিশিষ্ট ৪টি দৃষ্টিনন্দন ভবন।
জানা যায়, বিদ্যুত প্রকল্পে কর্মরত ৩ হাজারের অধিক রাশিয়ানসহ বিদেশীরা বসবাসও শুরু করেছেন। অন্যান্য আরও কয়েকটি ভবনের কাজ চলমান রয়েছে। আলাদাভাবে একটি পাওয়ার সাব স্টেশন নির্মাণ হয়েছে। আবাসিক কোয়ার্টারগুলোতে আধুনিক মানের সকল সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সরেজমিনে আবাসিক ভবনগুলো ঘুরে দেখা গেছে, সকল ইউনিটেই আসবাবপত্র সরবরাহ হয়েছে। এসি, ইন্টারনেট সংযোগ, টেলিফোন, রান্নার গ্যাস সরবরাহ এমনকি বাথরুমে গিজারের ব্যবস্থাও সকল ফাটেই রাখা হয়েছে। আধুনিকতার সবকিছুই আবাসিক কোয়ার্টারে বিদ্যমান।
পাবনা গণপূর্ত বিভাগ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অন্যান্য জনবলকে দিনরাত সার্বক্ষণিক কাজ করে সকলের আন্তরিক চেষ্টা, নিষ্ঠা, শ্রম ও একাগ্রতায় মাত্র ১৩ মাসে ৩টি ২০তলা ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। এতে সরকারের সকল দফতর, মন্ত্রণালয়, নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর তদারকি ছিল চোখে পড়ার মতো। দেশের প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রূপপুরের মতো অজপাড়াগায়ে মাত্র ১৩ মাসে সকল সুবিধাসহ বাংলাদেশীদের দ্বারা গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্বমানের গ্রীন সিটি।
জানা যায়, ৩টি ২০ তলা ভবনের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংস্থার চাহিদা ছিল ভবনগুলোতে সব ধরনের আসবাবপত্র দিয়ে সজ্জিত করে রাশিয়ানদের বসবাসের উপযোগী করা। সেই চাহিদার ভিত্তিতে প্রতিটি ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটের জন্য আসবাবপত্র ও হোম এ্যাপ্লায়েন্স ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু করে গণপূর্ত অধিদফতর। প্রতিটি ফ্ল্যাটে বেড, ডাইনিং টেবিল, চেয়ার, সোফা সেট, আলমিরা, টেলিভিশন, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, বিছানার চাদর, বালিশ কভার, ম্যাট্রেস, রুম কার্টেন, টিভি ট্রলি, কম্ফোর্টার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করার জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) মাধ্যমে ই-জিপিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। নিয়মানুযায়ী, ই-জিপিতে দরপত্র দাখিল কার্যক্রম উন্মুক্ত থাকায় যেকোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাতে অংশগ্রহণ করতে পারে। ই-জিপির টেন্ডার বহিঃসদস্য ও প্রত্যাশী সংস্থার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে যাচাই-বাছাই করে অনুমোদনের সুপারিশ করা হলে এতে দুর্নীতির সুযোগ থাকে না। কিন্তু মালামাল ক্রয় ও সরবরাহের জন্য আহ্বানকৃত দরপত্রে মালামাল উঠানোর জন্য বিপুল ব্যয়ের অভিযোগ তুলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি প্রাক্কলিত মূল্য ও কমিটি কর্তৃক সুপারিশকৃত মূল্যের মধ্যে বিপুল পার্থক্য নিরূপণ করে। দরপত্র বিজ্ঞপ্তি, সরকারী ক্রয় আইন ও বিধি কোনটিকেই তারা বিবেচনায় আনেননি। অথচ বিভিন্ন ফ্লোরে মালামাল উঠানোর জন্য আলাদাভাবে কোন টাকা ধরা হয়নি। মালামাল ক্রয় ও সরবরাহের জন্য আহ্বানকৃত দরপত্রে মালামাল উঠানোর জন্য বিপুল ব্যয় করার সঙ্গে ঠিকাদারের সংশ্লিষ্ট হওয়ারও কোন সুযোগ নেই। মালামাল উঠানোর কোন আইটেম শিডিউলেও নাই।
রূপপুর গ্রীন সিটি ঘুরে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে শুরু হয়ে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত ৩ বছরে ১১টি ২০তলা ভবন ও ৮টি ১৬তলা ভবন নির্মাণকাজ প্রায় সম্পন্ন হলেও ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের’ আওতায় বাস্তবায়নাধীন গ্রীন সিটি আবাসিক এলাকা নির্মাণ কাজের অগ্রগতি শুধু মন্থরই নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে একেবারেই বন্ধ হয়ে আছে। কারণ নির্মাণ কাজে ৩১ কোটি টাকা দুর্নীতি ও অপচয়ের অভিযোগে ওই কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল প্রকৌশলী ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কারাগারে পাঠানোর পরে গত দেড় বছরে নির্মাণ কাজের অগ্রগতি নেই বললেই চলে। অতিরিক্ত বিল প্রদান দেখিয়ে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে (২০১৪ সালের শিডিউল রেটে কাজের চুক্তি করা হলেও ২০১৮ সালের রেটে) প্রায় ৩৬ কোটি টাকা কেটে রাখা হয়েছে। নেয়া হয়েছে অতিরিক্ত আয়কর, ভ্যাট। যার ফলে আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর ছাড়াই নির্মিত ভবনগুলোতে বসবাস শুরু করেছেন রাশিয়ান বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে রাশিয়ান সরকারের যে চুক্তিপত্র (জিসিসি) রয়েছে তাতে নির্ধারিত সময়ে রাশিয়ান প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের আবাসন ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে না পারলে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। স্থানীয়রা বলছেন, বিশ্বমানের অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয় প্রচলতি ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা হয় না। যে আবাসন তৈরি হচ্ছে বিদেশীদের বসবাসের জন্য সেখানে তুলনামূলকভাবে অনেক ভাল উপকরণ ব্যবহার ও সরবরাহ না করলেও বসবাস করা কষ্টকর হবে।
বিদ্যুত কেন্দ্রের মূল প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই বালিশকা-ের অভিযোগ ওঠায় আবাসন ভবন নির্মাণ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের তাৎক্ষণিক শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। যারা রাতদিন ২৪ ঘণ্টা তিন শিফটে অক্লান্ত পরিশ্রম করে দ্রুততম সময়ে রূপপুরের গ্রীন সিটির নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছিল তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। অথচ পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র আইনের ১৯ ধারায় বলা আছে, সরল বিশ্বাসে করা কাজকর্মের ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনার কাজে সংশ্লিষ্ট কাউকে অভিযুক্ত করে কোন মামলা করা যাবে না। এই ধারা থেকে বেরিয়ে না এলে ভবিষ্যতে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়নে কেউ কাজ করতে চাইবে না। প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে নির্মাণ শিল্পের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় শুরু হবে। যথা সময়ে বিদ্যুত প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হলে উন্নয়নের নতুন মাত্রা যুক্ত হবে দেশের ইতিহাসে। মূল্যায়ন হবে প্রকৌশলী, ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্টদের। কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরেও নানা প্রশ্ন উত্থাপন হবে। অথচ একবারও কেউ বলবে না ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প বাস্তবায়নে কত সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে সংশ্লিষ্টদের।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের সার্বিক বিষয় জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ড. মোঃ শওকত আকবর বলেন, ‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যে আমরা কাজের গতি আগের থেকে বাড়িয়েছি। রিএ্যাক্টর ভবনের নির্মাণ কাজ এগিয়ে আছে। সব কাজ শিডিউল মতোই চলছে। তিনি বলেন, ১৩ মাসের মধ্যে তিনটি ২০তলা ভবন নির্মাণ করে প্রকৌশলী, ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্টরা নজির স্থাপন করেছেন। এ কাজের জন্য অবশ্যই তারা প্রশংসার দাবিদার।’