মুজিববর্ষের উপহার

admin
জানুয়ারি ২০, ২০২১ ১২:২০ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ডানা মেলছে গরিবের স্বপ্ন
‘গরিবের দুঃখু বুঝুইন বইল্যাই আমরারে ঘর দিছুইন’

শহরের মাছ বাজারে ১০ বছর ধরে ভিক্ষাবৃত্তি করে দিন গুজরান চলত শারীরিক প্রতিবন্ধী মিনা আক্তার (৪০)। বিধবা ওই নারী থাকেন সদর উপজেলার চকপাড়া গ্রামের অন্য এক ব্যক্তির আশ্রয়ে।
নিজের ঘর বা জমি বলতে কিছুই ছিল না তার। এই দরিদ্র মিনা আধাপাকা একটি ঘর পাচ্ছেন। সঙ্গে পাচ্ছেন একখণ্ড জমিও। মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গৃহীত ‘ভূিমহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ প্রদান কার্যক্রমের আওতায় এ জমি ও ঘর পাচ্ছেন তিনি।
জানতে চাইলে মিনা বলেন, ‘পাক্কা (পাকা) ঘরও থাকবাম, ঘুমাইয়াম- এইডা স্বপ্নেও কুনুদিন ভাবচি না।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ করে মিনা বলেন, ‘হেইন গরিবের দুঃখু বুঝুইন বইল্যাই আমরারে ঘর বানাইয়া দিছুইন।
আমরা তার লাইগ্যা পরান ভইরা দোয়া করি।’ শুধু মিনাই নন, তার মতো এমন ঘর ও জমি পাচ্ছেন জেলার মোট ৯৬০ জন ভূমিহীন ও গৃহহীন হতদরিদ্র মানুষ। প্রত্যেকের নামে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে দুই শতক করে খাস জমি।
আর তাতে ঘর নির্মাণ বাবদ ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ৭১ হাজার করে টাকা। যার পুরোটাই বহন করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। দুটি শয়নকক্ষ, একটি রান্না ঘর, সংযুক্ত পায়খানা-গোসলখানা ও সামনে বারান্দাসহ রঙিন টিনের ছাউনি দ্বারা এসব ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় এসব ঘরবাড়ি নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
জেলার ১০টি উপজেলার মধ্যে জেলা সদরে ৪৩টি, বারহাট্টায় ৪৫টি, আটপাড়ায় ৯৮টি, পূর্বধলায় ৫৩টি, দুর্গাপুরে ৩৫টি, কেন্দুয়ায় ৫০টি, কলমাকান্দায় ১০১টি, মদনে ৫৬টি, মোহনগঞ্জে ৩৬টি এবং হাওর উপজেলা খালিয়াজুরিতে ৪৪৩টি গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়া এসব পরিবারের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ এবং পানি সরবরাহে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের (ডিপিএইচই) ব্যবস্থাপনায় প্রতি ১০টি পরিবারের জন্য একটি করে সাবমারসিবল পাম্প বসানো হচ্ছে।
প্রতিটি উপজেলায় নিয়মিত নির্মাণ কাজ পর্যবেক্ষণ করছেন জেলা প্রশাসক কাজী মো. আব্দুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দেওয়ান মোহাম্মদ তাজুল ইসলামসহ অন্য কর্মকর্তারা।
নেত্রকোনা সদরের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ এরশাদুল আহমেদ বলেন, এরই মধ্যে ৯৫ ভাগ কাজ শেষ হয়ে গেছে।’
নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজি মো. আবদুর রহমান জানান, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৩ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঘর ও জমি বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। এ জন্য দ্রুত প্রত্যেকটি ঘরের নির্মাণ কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে।’
‘স্বপনেতও ভাবো নাই পাকা বাড়িত থাকি বা পারিমো’
একরাম তালুকদার, দিনাজপুর
‘সারাজীবন কাঁচা মাটি আগুনত পুড়ি হাঁড়ি-পাতিল বানাইছু, কিন্তু স্বপনেতও ভাবো নাই-কাঁচা মাটি পুড়ি ইট বানেয়া পাকা বাড়িত থাকি বা পারিমো। দুইটা বেটিক বিহা (বিয়ে) দিবার পর আর সহায়-সম্বলও নাই। সেইতানে চিন্তা করা তো দূরের কথা এই বুড়া বয়সোত আসি পাকা বাড়িত শুতিবা পারিমো, সেইটা স্বপনেতও ভাবি নাই। কিন্তু সরকার এখন হামাক পাকা বাড়ি করি দিছে। এখন মনে হচে জীবনটা স্বার্থক।’
চোখে-মুখে অন্যরকম এক উচ্ছ্বাস নিয়ে যুগান্তরের এই প্রতিবেদকের কাছে এমনই কথা জানাচ্ছিলেন, দিনাজপুরের বিরল উপজেলার শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামের ৬৭ বছর বয়স্ক অভাবী মৃৎশিল্পী রম্বিকা চন্দ্র পাল।
অভাবের সংসারে তার সন্তান বলতেই দুই মেয়ে। সহায়-সম্বল বিক্রি করে দুই মেয়ের বিয়ে দেয়ার পর এখন স্ত্রী নিয়ে থাকেন অন্যের জায়গায় ঝুপড়িঘর বানিয়ে। সারাজীবন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে এখন বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছেন। দু-মুঠোর আহার জোগাতেই হিমশিম খেতে হয় তাকে। এই শেষ জীবনে বাড়ি বানানোর কথা কখনই ভাবতে পারেননি তিনি।
তাও আবার পাকা বাড়ি। এতসবের মধ্যে শেষ জীবনে সরকারের দেয়া পাকা বাড়িতে ঠাঁই পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত তিনি। দিনাজপুরের বিরল উপজেলার বিজোড়া গ্রামে ‘জয়বাংলা পল্লীতে’ তিনি পেয়েছেন একটি পাকা বাড়ি।
একই পল্লীতে পাকা বাড়ি পাওয়া আক্তার বানু জানান, কুড়ি বছর আগে দিনমজুর শফিকুল ইসলামের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। স্বামীর জমি না থাকায় তার কুড়িটি বছর কাটে মানুষের পুকুরপাড়ে ঝুপড়ি বানিয়ে। তাও আবার মাঝে মাঝে জোরে বাতাস হলে সব উড়িয়ে নিয়ে যায়। স্বামীর যা রোজগার তা পেট শান্ত করতেই চলে যায়।
স্থায়ী ঠিকানার কথা ভাবতেই পারেননি। নিজের বাড়ি হবে, তাও আবার পাকা বাড়ি-এটি স্বপ্নেও ভাবেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারের দেয়া এমন পাকা বাড়িতে ঠাঁই মিলবে, যুগান্তরের কাছে এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেই দুই চোখে দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তার।
অতীতের দুর্বিষহ জীবন আর বর্তমানের এসব কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে আনন্দের কান্নায় হু হু করে কেঁদে উঠেন তিনি।
শুধু রম্বিকা চন্দ্র দাস আর আক্তার বানু নয়, ভিন্ন ভিন্ন হলেও অনুরূপ প্রতিক্রিয়া দিনাজপুর জেলার প্রায় ৪ হাজার ৭৬৬টি গৃহহীন পরিবারের। মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে দিনাজপুরে পাকা বাড়ি পাচ্ছেন এসব গৃহহীন পরিবার।
দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল আলম জানান, আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় দিনাজপুর জেলায় প্রথম পর্যায়ে বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৪ হাজার ৭৬৬টি বাড়ি।