মালয়েশিয়া সরকার ঘোষিত অবৈধ অভিবাসীদের বৈধকরণ প্রক্রিয়া আজ থেকে শুরু হচ্ছে। চলবে আগামী বছরের ৩০শে জুন অবধি। দীর্ঘ সাত মাসের ওই কর্মযজ্ঞে দুই লক্ষাধিক বাংলাদেশি বৈধতার সুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন বলে আশা করছেন দেশটির অভিবাসী বাংলাদেশিরা।
বাংলাদেশসহ ১৫ রাষ্ট্রের অনিয়মিত নাগরিকদের বৈধতার সুযোগ দিচ্ছে মালায়েশিয়ার নতুন নেতৃত্ব। কুয়ালালামপুর বলছে, এ কর্মসূচির জন্য কোনো এজেন্ট বা ভেন্ডর নেই। শুধু নিয়োগকর্তা বা কোম্পানি অবৈধ কর্মীদের নামসহ ইমিগ্রেশন নির্ধারিত ই-মেইলে আবেদন পাঠাবে। ব্যক্তি নিজে কিংবা কথিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এবার বৈধতার সুযোগ নেই। মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার খুরশেদ আলম খাস্তগীরের সঙ্গে আলাপে গতকাল তিনি বলেন, শ্রমশক্তির অন্যতম প্রধান গন্তব্য মালয়েশিয়া।
দেশটিতে অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশসহ ১৫ দেশের নাগরিকদের (সাধারণকর্মী) চার ক্যাটাগরিতে বৈধতা প্রদানের কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন মালয়েশিয়ার সরকার। বৈধতার এই খবরে আগের মতোই দেশি-বিদেশি অনেক প্রতারক চক্র, দালাল ও এজেন্ট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে অভিবাসীদের মাঝে লোভনীয় অফার ও অপপ্রচার চালাচ্ছে। এদের অফার এবং অপপ্রচারে কেউ যাতে বিভ্রান্ত বা প্রতারিত না হোন- এজন্য হাইকমিশন আগাম নানামুখী সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। এরইমধ্যে একটি গণনোটিশ জারি করা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার বলেন, বৈধতার জন্য অপরিহার্য পাসপোর্ট নিয়েও দুষ্টচক্র সক্রিয় রয়েছে এমন অভিযোগ আসছে। তবে মিশন এদের ঠেকাতেও এরইমধ্যে পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির পাসপোর্টপ্রাপ্তি নির্বিঘ্ন এবং সহজতর করতে ঢাকার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। দূতাবাসে কনস্যুলার ও শ্রম বিভাগ দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা অবশ্য দাবি করেন, পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সক্রিয়তায় চলমান করোনা মহামারির মধ্যে প্রায় লক্ষাধিক পাসপোর্ট ইস্যু এবং বিতরণ করেছে বাংলাদেশ মিশন। গত মে মাস থেকে গড়ে প্রতিমাসে ১২-১৫ হাজার পাসপোর্ট প্রদান সম্ভব হয়েছে বলে দাবি তাদের। তবে এখন বিশালসংখ্যক পাসেপোর্টের আবেদন ঝুলে আছে জানিয়ে তারা বলেন, বৈধতার ঘোষণায় পাসপোর্টের আবেদনের চাপ অনেকাংশে বেড়েছে। যেহেতু ঢাকায় পাসপোর্ট প্রিন্ট হয় সে ক্ষেত্রে এ বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সর্বাত্মক সহযোগিতা পাওয়া জরুরি। তা না হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বৈধতার আবেদন করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা পিছিয়ে পড়বে। এতে বৈধতা প্রত্যাশীদের দুর্ভোগ এবং অনিশ্চয়তা যেমন বাড়বে তেমনি হাইকমিশন এবং পাসপোর্ট অধিদপ্তরে দালালচক্রের উৎপাতও বেড়ে যাবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পাসপোর্ট ইস্যু এবং বিতরণ কার্যক্রম দ্রুততর করার ওপর জোর দেন তারা।
উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় থাকা অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে যারা সর্বশেষ বৈধকরণের সুযোগ বঞ্চিত হবেন, তাদের নিশ্চিতভাবে জেল-জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা মতে, ২০২১ সালের ৩০শে জুনের (নির্ধারিত ওই সময়) মধ্যে যারা বৈধতার আবেদন করতে বা বৈধতা পেতে ব্যর্থ হবে তাদের বিরুদ্ধে ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট কঠোর হবে। অবশ্যই তাদের তাড়িয়ে দেয়া হবে।
গত বৃহস্পতিবার অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা সংক্রান্ত কর্মসূচি গ্রহণের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় মালয়েশিয়া সরকার। যদিও এই সিদ্ধান্তটি অক্টোবরেই নেয়া হয়েছে। সেদিন এক বিশেষ বৈঠক শেষে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি হামজাহ বিন জায়নুদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, অবৈধ অভিবাসী শ্রমিকদের বৈধতা দেয়াসহ দু’টি পরিকল্পনা তারা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। প্রথমত: অবৈধ অভিবাসী শ্রমিকদের বৈধভাবে কাজে নিয়োগ। দ্বিতীয়ত: তাদের নিজ নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়া। ২০২১ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত এই দু’টি কার্যক্রম চলবে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রত্যাবাসন পরিকল্পনায় আওতায় অবৈধ অভিবাসীরা নির্দিষ্ট শর্তে মাতৃভূমিতে স্বেচ্ছায় ফিরে যাবেন। এতে মালয়েশিয়ার সরকার কোনো অতিরিক্ত ব্যয় করবে না বরং সরকার তাদের প্রত্যবাসনের বিষয়টি ফ্যাসিলিটেট বা নিশ্চিতে ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সহায়তা করবে।
মন্ত্রী জানান, যারা এবারের সুযোগটি গ্রহণ করতে আগ্রহী তাদের নিয়োগকর্তার মাধ্যমে ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট ও পেনিনসুলার মালয়েশিয়া লেবার ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ করতে হবে। সেদিন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজাহ অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতায় স্থানীয়দের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা নাকচ করে বলেন, আনুপাতিক হারে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা আছে। শূন্যপদ পূরণেও স্থানীয়দের অগ্রাধিকার রয়েছে। দেশটিতে তিন ডি-শ্রেণির কাজে অবৈধ অভিবাসীদের নিয়োগ দেয়ার সুযোগ সব সময় রয়েছে জানিয়ে কুয়ালালামপুরের তরফে বলা হয়- বিপজ্জনক, কঠিন, পরিচ্ছন্নতার কাজে বিদেশিদের কাজের সুযোগ অবারিত। এবারেও তাদের নির্মাণ, উৎপাদন, চাষাবাদ ও কৃষি- এই চার ক্যাটাগরিতে বৈধতা দেয়া হবে।
বাংলাদেশ মিশন প্রচারিত গণবিজ্ঞপ্তিতেও ওই চার ক্যাটাগরির কথা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়- কন্সট্রাকশন, ম্যানুফ্যাকচারিং, প্লান্টেশন এবং এগ্রিকালচার- এই চার সেক্টরে দেশটিতে অবস্থানরত অবৈধ বাংলাদেশসহ ১৫ রাষ্ট্রের অভিবাসীকে শর্তসাপেক্ষে বৈধতা দেবে মালয়েশিয়া। বিভিন্ন দেশের ২০ থেকে ৩০ লাখ অবৈধ অভিবাসী মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন বলে মনে করে অভিবাসন খাত নিয়ে কাজ করা এশিয়ার ২০টি দেশের আঞ্চলিক সংগঠন ক্যারাম এশিয়া। তবে বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসীর প্রকৃত পরিসংখ্যান তাদের হস্তগত হয়নি জানিয়ে বলা হয়- বাংলাদেশ কমিউনিটির ধারণা এ সংখ্যা কমপক্ষে দুই লাখ হবে।
ওদিকে বৈধতা ঘোষণার ওই মুহূর্তে বাংলাদেশের আটকে পড়া মালয়েশিয়া প্রবাসীদের ফেরতে নতুন করে আবেদনের নির্দেশনা জারি হওয়া সংক্রান্ত একটি ভুয়া খবর চাউর হয়েছে। এতে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন প্রবাসীরা। গত শুক্রবার এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও খবর ছাপা হয়। অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা ও নিজ দেশে ফিরতে মালয়েশিয়ার নির্দেশনা এবং সুখবর- বিষয়ক ওই খবরে বলা হয়, বাংলাদেশে আটকে পড়া প্রবাসীদের মালয়েশিয়ায় ফিরতে নতুন করে আবেদন করতে হবে। আবেদনটি বিবেচনার ভার একান্তভাবে মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত। সেই ভুয়া খবরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি হামজা বিন জায়নুদ্দিনকেও উদ্ধৃত করা হয় বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে। দায়িত্বহীন ওই সংবাদ পরিবেশনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মালয়েশিয়াস্থ প্রবাসী বাংলাদেশিরা। একাধিক প্রবাসী এমন রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বাংলাদেশ মিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যার প্রেক্ষিতে শনিবার মিশন গণ-নোটিশ জারি করে বলেও দাবি করা হয়েছে।