মানবপাচার মামলা পরিচালনাকারী রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, মামলার বিচারের ধীরগতি হওয়ার পেছনে চারটি কারণ। অভিযোগকারীর চেয়ে আসামিপক্ষ অর্থবিত্তে ক্ষমতাশালী হওয়া ও আসামিপক্ষ বেশি তৎপর থাকায় মামলার ওপর প্রভাব ফেলে। বাদীপক্ষ আদালতের বাইরে মীমাংসা করতে বাধ্য হয় এবং সেটি সম্ভব হয় অপরাধটির ভয়াবহতা নিয়ে প্রচার বেশি না থাকার কারণে। তারা এও বলছেন, কোন অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির না থাকলে, সেটি খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেয় না কোন পক্ষই। মানবপাচারের মামলাগুলো বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় খুব জরুরী। সম্প্রতি লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের গুলিতে নিহত ২৬ জন বাংলাদেশী মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ ও যশোরের অধিবাসী ছিলেন। এসব জেলার মানবপাচার বিষয়ক আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটরদের সঙ্গে কথা বলেও মানবপাচারের চলমান মামলার দীর্ঘসূত্রতাসহ এই চার কারণ জানা যায়।
অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিমানবন্দর থেকে শুরু করে লিবিয়া পর্যন্ত চক্রের জাল বিছানো। পাচারকারীরা দফায় দফায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা নেন। দেশ থেকে হুন্ডি করে টাকা আনাতে হয়। লিবিয়ায় প্রায়ই কোন দল অপহরণ করে নিয়ে যায়। মুক্তিপণ দিতে হয়। অনেক সময় অভিবাসনের নামে পাচার চলে। ইউরোপে অভিবাসনের হাতছানিতে গত বছরও ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছে এবং উদ্ধার হয়েছেন অনেক বাংলাদেশী। লিবিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ২০১১ সালে ৩৭ হাজার বাংলাদেশীকে ফেরত আনা হয়েছিল। তারপর দেশটি পাচারের পথ হয়ে ওঠে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে গড়ে ওঠা দালাল চক্র এলাকার লোককে এই পথে পাচারের ব্যবসায় যুক্ত।
অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, গত ২৭ মে লিবিয়ায় গুলিতে হত্যা করা হয়েছে ২৬ জন বাংলাদেশীকে। ২ জুন র্যাব কামাল হোসেন ওরফে হাজী কামালকে (৫৫) গ্রেফতার করেছে। র্যাব বলছে, তিনি মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা। অভিজ্ঞজনেরা যদিও বলছেন, মূল ব্যক্তিরা সচরাচর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। মানবপাচার চক্রের মূল অংশটি দেশের বাইরে। স্থানীয় পর্যায়ে কিছু দালাল কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা তথ্য দেন না। মানবপাচার মামলায় সাক্ষী নিয়মিত পাওয়া যায় না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনে ২০১২ সালে যে আইনটি করা হয়েছে, সেটি চমৎকার একটি আইন। তদন্ত ও শাস্তিসহ বেশকিছু বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু এই আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এছাড়া, জাতীয় যে কর্মপরিকল্পনা রয়েছে সেটাও ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মানবপাচারের মামলাগুলো বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যায়নি আট বছরেও। এ বছর সাতটি বিভাগে ট্রাইব্যুনাল চালু করে বিচার করার কথা আছে। মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনের যে আইনটি আছে তার বাস্তবায়ন করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই ধরনের উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন করা গেলে মানবপাচার সংক্রান্ত ভয়াবহ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো সম্ভব বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্মকর্তার দাবি।