১৯৬২ সালে জাপানের কাশিমা বন্দর তৈরির কাজ যখন শুরু হয়, তখন সেখানে ছিল ধানক্ষেত। বন্দর নির্মাণের পর সেটা পরিণত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে। বিশ্বের বড় বড় ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে এই বন্দর ঘিরে। বিখ্যাত এ কাশিমা বন্দরের আদলেই বাংলাদেশের কুতুবদিয়ায় বঙ্গোপসাগরের উপকূল মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’। এটা হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর।
একসময়ের লবণমাঠ খনন করে তৈরি হচ্ছে জাহাজ চলাচলের কৃত্রিম নৌপথ বা চ্যানেল। গত মাসে শুরু হওয়া বিশাল এই মহা কর্মযজ্ঞ পূর্ণতা পেলে বদলে যাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। গতকাল বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাতে এসে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করলেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সব ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করেছে। এটা অনেক বড় প্রকল্প হতে যাচ্ছে। বাস্তবায়নের পর মাতারবাড়ী হবে দ্বিতীয় সিঙ্গাপুর।’
এই সৌজন্য সাক্ষাতে উঠে আসে দুই দেশের পারস্পরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার নানা দিক। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার কথা তুলে ধরেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর। এ সময় জাপানি রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি আসিয়ান অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার যোগাযোগে ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে।
সায়েম সোবহান আনভীর বাংলাদেশে আরো জাপানি বিনিয়োগের আহ্বান জানালে ইতো নাওকি বলেন, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে জাপানি বিনিয়োগ এক ইতিহাস সৃষ্টি করবে বলে তিনি আশা করেন। সেখানে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে জাপান। ‘কম করে হলেও ১০০ জাপানি কম্পানির বিনিয়োগ থাকবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।’
করোনা মহামারিতেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রশংসা করেন জাপানের রাষ্ট্রদূত। তাঁর কথায় সহমত পোষণ করে সায়েম সোবহান আনভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘এটা সত্যি যে করোনা আসার পর থমকে গিয়েছিল সব কিছু। তবে এখন পরিস্থিতি বদলেছে। আশা করছি সব বাধা পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে আমাদের দেশ। উই বিলিভ ইন বাংলাদেশ। আমরা আত্মবিশ্বাসী, সব বাধা পেছনে ফেলতে পারব আর এগিয়ে যাব সামনে।’
বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে জাপানি রাষ্ট্রদূতের দীর্ঘ আলাপচারিতার সময় উপস্থিত ছিলেন কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, ডেইলি সান সম্পাদক এনামুল হক চৌধুরী, বাংলানিউজ সম্পাদক জুয়েল মাজহার, বসুন্ধরা গ্রুপের উপদেষ্টা আবু তৈয়ব, বসুন্ধরা কিংস সভাপতি ইমরুল হাসানসহ ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের কর্তারা।
জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা, বাংলাদেশ সরকার ও চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়নে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করছে মাতারবাড়ী উন্নয়ন প্রকল্প। দুই ধাপে বাস্তবায়িত হতে যাওয়া প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৬ সালের মধ্যে, যার বাজেট ১৮ হাজার কোটি টাকা। কাজ শেষ হওয়ার পর এই বন্দরে ভিড়তে পারবে ১৮ মিটার গভীরতার জাহাজ। সাধারণত ১৪ মিটার গভীরতার জাহাজ যে বন্দরে ভিড়তে পারে, সেটাকেই বলে গভীর সমুদ্রবন্দর। এ জন্যই উচ্ছ্বসিত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে উন্নতির রোল মডেল। এখানকার ভৌগোলিক অবস্থানটি দুর্দান্ত। এ জন্য বাংলাদেশে অনেক বিনিয়োগ বেড়েছে জাপানের। আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি জাপানি কম্পানি কাজ করছে এখন বাংলাদেশে। সংখ্যাটি ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে।’
সায়েম সোবহান আনভীরের বাসভবনে মধ্যাহ্নভোজ শেষে ইতো নাওকি আরো জানিয়েছেন, ২০২৫ সালে নতুন এক বাংলাদেশ পাবে বিশ্ব। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বদলে যাবে বাংলাদেশের চেহারা। থার্ড টার্মিনাল, মাতারবাড়ী প্রকল্প, মেট্রো রেল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ বিশ্বে নতুন স্থান করে নেবে। করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবেলা করে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন তিনি। চীন, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের পণ্য জাপানে বেশি রপ্তানি হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন জাপানি রাষ্ট্রদূত। তাতে এই বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরালো হবে বাংলাদেশের।
এক বছরের জন্য পিছিয়ে যাওয়া টোকিও অলিম্পিক আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েও কথা বলেন ইতো নাওকি।