সব ধরনের গুজব উপেক্ষা করে ভাসানচরে উন্নত জীবনের আশায় ছুটছে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র থেকে দ্বিতীয় দফায় আজ ৪২৮টি পরিবারের সদস্যরা স্বেচ্ছায় নতুন আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছে।
সোমবার টেকনাফ থেকে ১৮০৪ জনকে বাসে করে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে আজ সকালে নৌবাহিনীর ৫টি জাহাজ তাদের নিয়ে ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা দেবে। অথচ সরকারের পরিকল্পনা ছিল এ দফায় সাতশ’ জনকে স্থানান্তর করা হবে।
কিন্তু তাদের আগ্রহের কারণে এই সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। এর আগে প্রথম দফায় ১৬৪২ রোহিঙ্গা নতুন ঠিকানায় পৌঁছায়।
অথচ কয়েকদিন আগেও এই ভাসানচর নিয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হয়েছে। রোহিঙ্গাদেরই একটি অংশ প্রচার করেছে-নতুন স্থানে গেলে পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলা হবে, বন্দি করে রাখা হবে জেলখানার কয়েদিদের মতো।
এমন অসংখ্য গুজবে টেকনাফ ও উখিয়ার ক্যাম্পগুলোয় এক ধরনের ভীতিও ছড়িয়ে পড়েছিল। ভাসানচর পরিদর্শনের পরও তাদের একটি অংশের মধ্যে শঙ্কা ছিল এখানকার পরিবেশ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে।
কিন্তু প্রথম দফায় স্বেচ্ছায় আসা রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের পর পাল্টে গেছে সেই চিত্র। এখন নিজেরাই ভাসানচরে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
ফলে দ্বিতীয় দফায় ৭০০ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ১৮০৪ জনকে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র থেকে আনতে হয়েছে।
সোমবার দ্বিতীয় দফায় উখিয়া থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হয় বাস। বিকাল ৫টা পর্যন্ত ৩৯টি বাস উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠ এলাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়।
প্রতি ১০টি বাসের অন্তর অন্তর ছিল একটি করে পুলিশের গাড়ি এবং একটি অ্যাম্বুলেন্স। এর আগে রোববার বিকাল ও সোমবার সকালে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যেতে উখিয়া কলেজ মাঠে অস্থায়ী ট্রানজিট পয়েন্টে নিয়ে এসে রাখা হয়।
অনেক পরিবার হেঁটে হেঁটে ট্রানজিট ক্যাম্পে এসেছে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। চট্টগ্রামে সোমবার রাতে অবস্থান শেষে বোট ক্লাব থেকে নৌবাহিনীর জাহাজ এলসিইউ (ল্যান্ডিং ক্রাফট ইউটিলিটি) দ্বারা তাদেরকে ভাসানচর নেয়া হবে।
ভাসানচর প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবনমান বদলে দেয়ার সব আয়োজন রয়েছে ভাসানচরে। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) স্ট্যান্ডার্ড মেনে তৈরি করা হয়েছে পরিকল্পিত আবাসন।
২২টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) সেখানে কাজ শুরু করেছে। পরিকল্পিত আবাসন, ভাসানচরের পরিবেশ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সন্তুষ্ট হয়ে প্রথম দফায় আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজার ক্যাম্পে থাকা স্বজন ও পরিচিতদেরও আসতে বলেছেন।
সে কারণেই সরকারি পরিকল্পনার দ্বিগুণেরও বেশি রোহিঙ্গাকে নিতে হচ্ছে ভাসানচরে। এখন পরিকল্পনার বেশি মানুষকে আনা সম্ভব হলেও সামনে হয়তো সেটি সম্ভব হবে না। কারণ, সেখানে ১ লাখ রোহিঙ্গার আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে। পরে চাইলেও সবাইকে নেয়া যাবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভাসানচর আবাসন প্রকল্পের পরিচালক নৌবাহিনীর কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে এই প্রকল্পের কাজটি আমরা করেছি।
আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে থাকার ঘরগুলো তৈরি করা হয়েছে। ভাসানচর কেমন হবে-সেটা নিয়ে শুরুতে অনেক রোহিঙ্গার মধ্যে এক ধরনের চিন্তা ছিল। আমরা তাদের অভয় দিয়েছিলাম।
তারাও এসে প্রকল্প দেখে গিয়েছে। এরপর প্রথম দফায় ১ হাজার ৬৪২ জন এখানে আসে। এরপরই পাল্টে যেতে থাকে চিত্র। তারা ভাসানচরের সুযোগ-সুবিধা দেখে কক্সবাজার ক্যাম্পে জানায়।
ফলে ভাসানচরে আসতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। দ্বিতীয় ধাপে পরিকল্পনার দ্বিগুণের বেশি রোহিঙ্গাকে নিয়ে আসা হচ্ছে, যা প্রথম ধাপে আসা মোট রোহিঙ্গার চেয়ে ১৩০ জন বেশি।
যুগান্তরের উখিয়া প্রতিনিধি জানান, উখিয়া ও টেকনাফের তালিকাভুক্ত ছাড়া বাকি সব ক্যাম্প থেকেই রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যাওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে।
বিশেষ করে উখিয়ার কুতুপালং-১, ২, ৩, ৪, ৫, ৮ ডব্লিউ ও থাইংখালী ১৩ নম্বর ক্যাম্প থেকে অনেক রোহিঙ্গা পরিবার সোমবার ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে।
ক্যাম্প ২৬ এবং ২৭-এর ইনচার্জ খালিদ হোসেন বলেন, ২৬ নম্বর থেকে ২৩ জন রোহিঙ্গা ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা হয়েছে।
উখিয়ার কুতুপালংয়ের নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ক্যাম্পের মাঝিরা জানান, প্রথম দফায় স্থানান্তরের চেয়ে এবারের চিত্র উল্টো। ওই সময় রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিতে অনেক বোঝাতে হয়েছে।
কিন্তু ২০ দিনের মধ্যে চিত্র পাল্টেছে। এবার ভাসানচরে যেতে নিজেরাই তালিকায় নাম লিখিয়েছে। ৪ ডিসেম্বর যাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনরা গেছে, তাদের কাছে সুযোগ-সুবিধার খবর শুনে অনেকেই যেতে উদ্গ্রীব হয়ে পড়েছে।
উখিয়ার কুতুপালং এলাকার ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন জানান, স্বেচ্ছায় যারা যেতে ইচ্ছুক, শুধু তাদেরই নেয়া হচ্ছে।
এদিকে ভাসানচরে কাজ করছে ২২টি এনজিও। এসব এনজিওর প্রতিনিধিরাও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এখানে আসতে আগ্রহী হওয়ার কারণ হিসেবে তারা উন্নত সুযোগ-সুবিধার কথা জানিয়েছেন।
তারা বলছেন, নতুন ঠিকানায় কক্সবাজারের চেয়ে ১৮টি উন্নত সেবা ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে।
এগুলো হল : উন্নত আবাসন, পর্যাপ্ত সুপেয় পানি, পরিবেশসম্মত স্যানিটেশন সুবিধা, খাদ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, জীবিকানির্বাহের সুযোগ, স্থান ব্যবস্থাপনা, উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ, দুর্যোগে ক্ষতির ঝুঁকি কম, পর্যটনের ওপর প্রভাব কম, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা, মানব ও মাদক পাচার বন্ধ, অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কম, উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বিকল্প রান্নার ব্যবস্থা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কক্সবাজারের প্রকল্প পরিচালক মো. জনাব আলী সোমবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, কক্সবাজার থেকে যেসব রোহিঙ্গা এসেছে তারা অত্যন্ত খুশি।
থাকার ঘরের পরিবেশে তাদের মধ্যে সন্তুষ্টি দেখা গেছে। এরাই আত্মীয়স্বজনকে ফোন করে সুযোগ-সুবিধাগুলোর কথা জানিয়েছে। ফলে বাকিদের মধ্যেও ভাসানচরে আসতে আগ্রহ বেড়েছে। জনাব আলী ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছেন।
রোহিঙ্গাদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করা মাল্টি সার্ভ ইন্টারন্যাশনালের (এমএসআই) নির্বাহী প্রধান মো. জুবায়ের যুগান্তরকে বলেন, আবাসন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎসহ সব মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা।
কক্সবাজার আর ভাসানচরে সুযোগ-সুবিধার ব্যবধান আকাশ-পাতাল। সে কারণেই রোহিঙ্গারা আসতে আগ্রহী হচ্ছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনে দেশটি থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য নোয়াখালীর ভাসানচরে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক সুবিধা সংবলিত পরিকল্পিত অস্থায়ী আবাসন প্রকল্প।
ব্রিটিশ কোম্পানির ডিজাইনে শক্তিশালী বাঁধ দিয়ে দ্বীপকে সুরক্ষিত করা হয়েছে।