অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রেই পাকিস্তানকে ক্রমেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রতিবছরই আসছে নতুন নতুন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার খবর। অবশ্য শুধু অর্থনীতি নয়, পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় সবক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি ভারতের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে বাংলাদেশ। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকে ভারতের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের থেকেও এগিয়ে। ভারত ও পাকিস্তানের অনেক পরে স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশের স্বাস্থ্য-শিক্ষার দিক দিয়ে ছাড়িয়ে যাওয়া চমক তৈরি করেছে পুরো বিশ্বেই। কারণ ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভাগ হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান। দুই দেশের পাশাপাশি দুই বাংলা ভাগ হয়ে বাঙালির হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ
ঘটিয়েছিল, তা আজও বন্ধ হয়নি। সেই দেশ ভাগেরও ২৪ বছর পর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। নিউইয়র্কভিত্তিক একটি জনপ্রিয় বিজনেস পোর্টাল কোয়ার্টজ ডটকম বলেছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে অগ্রসরমান এশিয়ার অন্যতম প্রতিনিধিত্বশীল দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। এটি বিশ্বের একমাত্র দেশ ২০২০ এবং ২০২১ এই বছরেই যাদের প্রবৃদ্ধি হবে ২ শতাংশের বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ তথ্য বলছে, বাংলাদেশের পাকিস্তানের ছাড়িয়ে যাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনটি ঘটতে যাচ্ছে চলতি ২০২১ সালে। সূচক বিবেচনার বাইরে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি শক্তিশালী তার আত্মপ্রকাশ হবে এ বছরই। যদিও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে দুই বছর আগে, আর মাথাপিছু জিডিপিতে ছাড়িয়েছে তিন বছর আগে। আইএমএফ বলছে, ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে ২০২১ সালে পাকিস্তান যে পিছিয়ে পড়তে যাচ্ছে সে অবস্থান থেকে পাকিস্তান আর বাংলাদেশকে ধরতে পারছে না সহসাই।
জানা যায়, আইএমএফের প্রাক্কলন নিয়েই ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত রয়েছে গত এক বছর ধরেই। কারণ গত বছরই আইএমএফের প্রাক্কলনে মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ। এই প্রাক্কলনের বড় কারণ ছিল ওই বছরে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক, বিপরীতে বাংলাদেশের ছিল ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থনৈতিক এই ছাড়িয়ে যাওয়ার সাফল্য এক বছরের জন্য হলেও গত এক দশকে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে ব্যবধান অনেক কমিয়ে এনেছে। অবশ্য সামাজিক অন্যান্য খাতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অর্জন আছে বাংলাদেশের। শিশুমৃত্যুর হারের ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ভালো। ভারতে যেখানে প্রতি ১০০০ জনে ২৯.৯ এবং পাকিস্তানে ৫৭.২ জন শিশু মারা যায়, সেখানে বাংলাদেশ এই শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে এনেছে ২২.১ জনে। শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশের ক্ষেত্রেও তিন দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রেটিং ৪.১। ভারতের ৫.৭ এবং খুব খারাপ অবস্থায় থাকা পাকিস্তানের রেটিং ৯.৭।
শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে রীতিমতো ছক্কা মেরে দিয়েছে বাংলাদেশ (১১৬.৫%)। এরপর আছে ভারত (১১২.৯%) এবং পাকিস্তান (৯৪.৩%)। যদিও শিক্ষার হারের ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে ভারত। সেখানে শিক্ষার হার ৭৪.৪%। সামান্য পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের শিক্ষার ৭৩.৯%। সবার শেষে থাকা পাকিস্তানের শিক্ষার হার ৫৯.১৩%। জনবহুল এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি থাকা তিন দেশের মধ্যে জন্মহার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও প্রথম স্থান বাংলাদেশের (২.০)। দ্বিতীয় স্থানে আছে ভারত (২.২) এবং তৃতীয় স্থানে পাকিস্তান (৩.৫)।
গড় আয়ুর ক্ষেত্রেও তিন দেশের মধ্যে শীর্ষস্থান বাংলাদেশের। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৩ বছর। ভারতে ৬৯.৪ এবং পাকিস্তানে ৬৭.১ বছর।
বায়ু দূষণের ক্ষেত্রেও ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। ভয়াবহ অবস্থা ভারতে (৯০.৯) সেখানে বাংলাদেশের (৬০.৯)। এক্ষেত্রে পাকিস্তান আছে ভালো অবস্থানে। মোট ব্যয়ের মধ্যে কম সংখ্যক অর্থ সামরিক খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রের তিন দেশের মধ্যে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। তিন দেশের মধ্যে শীর্ষে আছে বাংলাদেশ (১.৪%), দ্বিতীয় স্থানে ভারত (২.৪%) এবং পাকিস্তান ৪.০%।
গণতন্ত্রের সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি-ডেম ইনস্টিটিউট লিবারেল ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্সে তিন দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে, দ্বিতীয় ভারত, শেষ অবস্থানে পাকিস্তান। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ওয়াশিংটনভিত্তিক কনজারভেটিভ থিংক ট্যাংক দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের তালিকা অনুযায়ী, করের বোঝা, ব্যক্তিগত ও করপোরেট পরিসরে করের হার এবং মোট দেশজ উৎপাদনের তুলনায় শতাংশ হিসেবে মোট আদায়কৃত কর রাজস্ব আয়- এসব বিষয় বিবেচনায় ৫৬.৫ স্কোর করে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। পাকিস্তানের অবস্থান পাকিস্তান ১৫২তম। বাংলাদেশের সমান স্কোর নিয়ে ১২১তম অবস্থানে আছে ভারত। তবে বাংলাদেশ এ বছর দশমিক ১ পয়েন্ট স্কোর করায় ও এ বছর ভারত কোনো স্কোর না করায় অবস্থানের এই হেরফের হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনৈতিক যে কোনো সূচকে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া একটি বিশাল ঘটনা। কারণ ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশ এখন। মোট জিডিপির দিক থেকে বিশ্বের প্রথম ৫টি দেশের একটি ভারত। মোট জিডিপির দিক থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অংশ ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ, আর বাংলাদেশের অংশ দশমিক ৩৪ শতাংশ। সুতরাং এ দিক থেকে তুলনাই চলে না। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের অর্থনীতি ১০ গুণ বড়। সুতরাং এত বড় এক অর্থনীতির দেশকে পেছনে ফেলে দেওয়া আসলেই সাফল্য।
ভারতের বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে শ্রমশক্তিতে নারীদের উচ্চতর অংশগ্রহণ একটি বড় ভূমিকা রাখছে। আর এখানেই ভারত যথেষ্ট পিছিয়ে। আর শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। এই পোশাক খাতকে নিয়েই বিশ্ববাজারে একটি ভালো স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। হিসাব বলছে, শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণের হার ৩২ শতাংশ, আর ভারতে তা মাত্র ২০ দশমিক ৩ শতাংশ।
দ্য ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন জিডিপির দিক থেকে বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি শিল্প ও সেবা খাতনির্ভর। এই খাতই এখন কর্মসংস্থান তৈরি করছে, যা কৃষি খাত করতে পারছে না। অন্যদিকে, ভারত শিল্প খাতকে চাঙা করতে হিমশিম খাচ্ছে আর মানুষ এখনো অনেক বেশি কৃষি খাতনির্ভর। এর বাইরে আরও কিছু সামাজিক সূচকও বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। যেমন স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ।