আধুনিক প্রযুক্তি, সময়োপযোগী কৃষিনীতি আর কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বদলে গেছে দেশের কৃষির চিত্র। কৃষিক্ষেত্রে সবজি চাষে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। সবজির উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষকদের আয়ও বেড়েছে। দেশের পূর্বাঞ্চলের কৃষক বিবর্তিত জলবায়ুর সাথে সংগ্রাম করে কৃষি বিপ্লবে এখন মাঠে ময়দানে কাজ করছেন। বৈরী আবহাওয়াকে চ্যালেঞ্জ করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলাতে এখন কঠোর পরিশ্রম করছেন। এ যুদ্ধ গ্রামে গ্রামে মাঠে মাঠে বাড়ির আঙ্গিনায় আঙ্গিনায়। এ সংগ্রাম যেন সর্বত্র।
মাটির মাঝে তুলে আনছে ফসলের খাটি সোনা। গত দুই যুগ আগের কৃষি কাজের সাথে বিস্তার ফারাক এখনকার প্রযুক্তি। যেখানে একদা সবজি চাষ ছিল আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র সেখানে সবজি চাষ এখন আশীর্বাদ। সবজির মূল্যও এখন কম নয়। সারা বছর গড়ে কোন সবজির দামই ৪০ টাকার নিচে নয়। কৃষক তাই কোমর বেধে কৃষিযজ্ঞে আমুল পরিবর্তন আনছে। তাই উচ্চফলনশীল সবজি চাষ পূর্বাঞ্চলের কৃষকের ভাগ্য ক্রমেই বদলে দিয়েছে এই সবজি চাষ বিপ্লব। গ্রামে গ্রামে চাষ হচ্ছে এ সবজি। পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে কম খরচে অধিক লাভ হওয়ায় কৃষকরা এখন উচ্চফলনশীল জাতের শাক-সবজির চাষ করছেন। চাষিরা দেশীয় বীজ বাদে হাইব্রিড চাষ করে অধিকফলন ফলাচ্ছে। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতর ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করর্পোরেশন সা¤প্রতিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষিকাজে সেকেলে যন্ত্রপাতির বদলে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের। কেবল জমি চাষই নয়, জমিতে সার দেওয়া, কীটনাশক ছিটানো থেকে শুরু করে সবই আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে করা যাচ্ছে।
কৃষি অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ব্রাক্ষণবাড়িয়াসহ দেশের পূর্বাঞ্চলে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মাঠে ঘাটে সবজি চাষ অব্যাহত রেখেছেন। কৃষিবিদরা মনে করছেন সরকারের যুগোপযোগী পরিকল্পনা, কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার, পরিশ্রমী কৃষক এবং মেধাবী কৃষি বিজ্ঞানী যৌথ প্রয়াসেই এমন সাফল্য এসেছে।
কৃষি বিভাগের পরামর্শে পূর্বাঞ্চলের হাজার হাজার হেক্টর জমিতে সবজি চাষ এখন নজর কাড়ার মত। যেখানে কোনদিন সবজি চাষের অস্তিত্বই ছিল না সেখানে এখন সবুজের সমরাহ। বুড়িচং উপজেলার শিকারপুর গ্রামের কৃষক রমিজ উদ্দিন দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ১১-১২ বছর ধরে তিনি কৃষি কাজের সাথে আছেন। এটি তার প্রধান পেশা। চলতি বছর ৫ বিঘা জমিতে লাউ চাষ করে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকার বেচা কেনা করেছেন। প্রতিদিন ২শ’ থেকে ৩শ’ লাউ বাজারজাত করেন। সাথে কপি ও শিম চাষ চলছে। ডুবাইরচর গ্রামের কৃষক আব্দুল করিম (৫২) ছোট বেলা থেকেই কৃষি কাজ করে সংসার চালান। এ বছর ২ একর জমিতে বরবটি লাগিয়েছেন। প্রতিদিন ১-২ মণ বরবটি তুলছেন। এতে তার খরচ হয়েছে মাত্র ৪৫ হাজার টাকা। ইতোমধ্যেই তিনি ৪০ হাজার টাকার বরবটি বিক্রি করেছেন।
শ্রীমন্তপুর গ্রামের কৃষক আমিরুল ইসলাম তিন বছর ধরে শিম আবাদ করে ভালো দাম পেয়েছেন। এবার শিমের পাশাপাশি অন্যান্য সবজিও চাষ করেছেন। অল্প সময়ে ফসল তোলার পাশাপাশি রোগবালাই এবং লোকসানের শঙ্কা কম বলে আমিরুলের মতো অনেকেই এখন সবজি চাষ করছেন। ডুবাইরচর গ্রামের কৃষক রমজান আলী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, তার জমিতে লাউ, বরবটি, মূলা ও ডাটা শাক রোপন করে তার খরচের টাকা উঠে এখন লাভের মুখ দেখেছে। গত বছর ৩শ’ ঝাড়ে আলাভী গ্রীণ জাতের শসা, টিয়া জাতের করলা এবং মার্টিনা জাতের লাউ বীজ রোপণ করেছিলেন। এবার লাউ শাক বিক্রি করে বেশ টাকা এসেছে।
এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরিচালক সুরজিত দত্ত দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ফলন ভালো হওয়ায় কৃষক উচ্চফলনশীল সবজি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। উচ্চফলনশীল সবজি চাষে অল্প খরচে দ্বিগুণ লাভ হওয়ায় চাষিদের মাঝে ব্যপক সাড়া ফেলেছে। কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে। চাষাবাদে কাঠের লাঙ্গলের ব্যবহার হয় না বললেই চলে। কৃষি কাজের মধ্যে সবচেয়ে শ্রমনির্ভর কাজ হচ্ছে বীজ বা চারা রোপণ, আগাছা দমন ও ফসল কাটা। মৌসুমের নির্দিষ্ট সময়ে বীজ বপন, চারা রোপণ এবং ফসল কেটে ঘরে তুলতে কৃষককে বেশ সঙ্কটে পড়তে হয়। ওই সময়ে কৃষি শ্রমিকের মজুরি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। কখনো কখনো দ্বিগুণ মজুরি দিয়েও কৃষি শ্রমিক পাওয়া যায় না। ফলে বিলম্বে বীজ রোপণের জন্য ফলন কম হয়, পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পায়। এসব থেকে রক্ষা পেতেই কৃষি কাজে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করায় এতে যেমন সময় কম লাগছে, তেমনি বেশি ফসলও উৎপাদন হচ্ছে। যার ফলে কৃষক লাভবান হচ্ছে।
সবজি চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন ফেনি’র কৃষকেরাও। এক সময় তারা ধানের উপর নির্ভনশীল থাকলেও এখন সবজি চাষ করছেন। অল্প সময়ে ফলন, খরচ কম এবং দাম ভালো পাওয়ায় কৃষকদের মাঝে আগ্রহ বাড়ছে সবজি চাষে। ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার কসবা’র কৃষক শাহআলম সোহেল তিন বছর ধরে শিম আবাদ করে ভালো দাম পেয়েছেন। এবার শিমের পাশাপাশি অন্যান্য সবজিও চাষ করেছেন। অল্প সময়ে ফসল তোলার পাশাপাশি রোগবালাই এবং লোকসানের শঙ্কা কম বলে শাহআলম সোহেলের মতো অনেকেই এখন সবজি চাষ করছেন। কৃষি বিপণন অধিদফতরের মতে, শস্য বিন্যাসের পাশাপাশি চাহিদা ও উৎপাদন কাছাকাছি থাকায় ভালো দাম পাচ্ছেন কৃষক। যার ফলে ফলন বাড়ার সাথে সাথে ভাগ্যে বদলাছে কৃষকেরও।