বেসরকারী খাত চাঙ্গা সরকারী প্রণোদনায়

admin
নভেম্বর ৯, ২০২০ ৪:৩৬ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

করোনাকালের অর্থনীতি ()

ব্যাংকিং খাতে শক্তি জোগাচ্ছে সরকারের ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ। এরমধ্যে আটটি ব্যাংক ঋণভিত্তিক, যার পরিমাণ ৯২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি ১৩টি সরকারী নগদ সহায়তা বা অনুদান। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ২৬ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণসুবিধা নিয়ে যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য যথাসময়ে শুরু করা যায়, সে জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণের নির্দেশনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। প্রণোদনা ঋণের পাশাপাশি নানা নীতি-সহায়তার ফলে অধিকাংশ ব্যাংকে এখন ঋণ দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে। তবে প্রণোদনার ঋণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে তৎপর থাকার পাশাপাশি বেসরকারী বিনিয়োগ আর কর্মসংস্থান বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

জানা গেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে মার্চ থেকে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘ সরকারী সাধারণ ছুটিতে জনজীবন ছিল স্থবির। এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ শিল্প কারখানা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও বিশ্ববাণিজ্য বন্ধ থাকায় চাপে পড়ে যান ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে কোন প্রতিষ্ঠান যেন বন্ধ না হয়, সে জন্য গত ৫ এপ্রিল বিভিন্ন খাতে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বিভিন্ন সময়ে এই প্যাকেজের পরিমাণ বাড়িয়ে ১ লাখ ১৯ হাজার ২৬৯ কোটি টাকার মোট ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এই প্রণোদনা প্যাকেজের ৯২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার বেশি জোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য বেশ কয়েকটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন এবং বিদ্যমান তহবিলের আকার বাড়ানো হয়েছে। এর আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৫১ হাজার কোটি টাকার মতো তহবিলের জোগান পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এ ছাড়া সিআরআর দুই দফায় দেড় শতাংশ কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে আরও ১৯ হাজার কোটি টাকা নতুন করে ঋণ দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করে ব্যাংকগুলো। বাজেট বরাদ্দ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার জোগান দেয় সরকার।

প্যাকেজের বাকি ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলোর নিজস্ব উৎস থেকেই বিতরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও ব্যাংকের যাতে সঙ্কট না হয়, সে জন্য তারল্য বাড়াতে তিন দফায় রেপো রেট কমিয়ে ৪.৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। চালু করা হয়েছে এক বছর মেয়াদী বিশেষ রেপো। ১৭ বছর পর ব্যাংক রেট ১ শতাংশ কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ব্যাংকের মুনাফা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বণ্টন ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আবু ফরাহ মোঃ নাছের জনকণ্ঠকে বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার একটা উদ্দেশ্য আছে। সেটা যেন ব্যাহত না হয় সে জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এটা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেশের সব ব্যাংকে বারবার তাগাদা দেয়া হচ্ছে। এতে ঋণ বিতরণে আগের চেয়ে বেশ গতিও এসেছে।

জানা গেছে, শিল্প ও সেবা খাতে শুরুতে ৩০ হাজার কোটি টাকা বিতরণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। পরে এ তহবিল থেকে রফতানিমুখী শিল্পের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য আকার আরও তিন হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়। গত সপ্তাহে এ প্রণোদনায় নতুন করে সাত হাজার কোটি টাকা যুক্ত হয়েছে। ফলে বৃহৎ শিল্পের চলতি মূলধন জোগান প্যাকেজের আওতা দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। বেজা ও বেপজার অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাইটেক পার্কের মতো বিশেষায়িত অঞ্চলে অবস্থিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ভর্তুকি সুদে বিতরণের জন্য অতিরিক্ত এ অর্থ প্যাকেজে বরাদ্দ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন পর্যন্ত এ খাতে বিতরণ করা হয়েছে মোট ২৫ হাজার কোটি টাকা।

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ চলতি নবেম্বরের মধ্যে বিতরণ শেষ করতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সিএমএসএমই-এর প্যাকেজ থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। এদিকে ক্ষুদ্রশিল্পের ঋণ বিতরণ বাড়াতে গত ২৮ অক্টোবর সিএমএসএমই খাতের ব্যবসা উপ-খাতের জন্য বরাদ্দ বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে এখন থেকে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ প্যাকেজের মোট বিতরণ করা ঋণের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ সিএমএসএমই খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দিতে পারছে। বাকি ৭০ শতাংশ ঋণ যাবে উৎপাদন ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানে।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত ইডিএফের সুবিধা বাড়িয়েছে বরাদ্দ ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, প্রাক-জাহাজীকরণ পুনঃঅর্থায়ন স্কিম খাতে বরাদ্দ পাঁচ হাজার কোটি, কৃষি পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে বরাদ্দ পাঁচ হাজার কোটি, নি¤œ আয়ের পেশাজীবী কৃষক/ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে বরাদ্দ তিন হাজার কোটি এবং কর্মসৃজন কার্যক্রমে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ও পিকেএসএফের মাধ্যমে দুই হাজার কোটি টাকা বিতরণের ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে।

অন্যদিকে করোনাকালে সরকারী সহায়তার আওতায় সরাসরি প্রণোদনার মধ্যে রয়েছে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ সম্মানী বাবদ ১০০ কোটি টাকা, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অথবা মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭৫০ কোটি টাকা, বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ খাতে বরাদ্দ দুই হাজার ৫০৩ কোটি টাকা, ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি খাতে বরাদ্দ ২৫১ কোটি টাকা, লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে নগদ অর্থ বিতরণ বাবদ বরাদ্দ এক হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, ভাতা কর্মসূচীর আওতা বাড়িয়েছে মোট বরাদ্দ ৮১৫ কোটি টাকা, গৃহহীন মানুষের জন্য গৃহনির্মাণ বাবদ বরাদ্দ দুই হাজার ১৩০ কোটি টাকা, বোরো ধান-চাল ক্রয় কার্যক্রমে বরাদ্দ ৮৬০ কোটি টাকা, কৃষিকাজ যান্ত্রিকীকরণে তিন হাজার ২২০ কোটি টাকা এবং কৃষি ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর বাইরে রয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গত মে মাসে স্থগিত করা ঋণের আংশিক সুদ মওকুফ বাবদ সরকারের ভর্তুকি দুই হাজার কোটি টাকা, ক্রেডিট রিস্ক শেয়ারিং স্কিম (সিআরএস) ফর এসএমই সেক্টর বাবদ দুই হাজার কোটি টাকা এবং রফতানিমুখী তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকাশিল্পের দুস্থ শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় এক হাজার ১৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ইডিএফ ফান্ডের ৫০০ কোটি টাকার তহবিল থেকে বিতরণ করা হয়েছে ৪২ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। করোনার কারণে এই ফান্ডের আকার বাড়ানো হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রাণহীন অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকার যখন প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তখনই সেটা বাস্তবায়নে নীতিমালা জারি করা হয়েছে। প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলো যাতে কোন ধরনের সঙ্কটে না পড়ে সে জন্য বাজারে তারল্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, বড় বড় প্রতিষ্ঠান সরকারী প্রণোদনার মাধ্যমে সচল হলেও মাঝারি বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠান সেভাবে প্রণোদনা পায়নি। তাই তাদের বিষয়ে ভাবার পরামর্শ দেন তিনি।

এদিকে প্রণোদনার ঋণের পাশাপাশি নানা নীতি-সহায়তার ফলে অধিকাংশ ব্যাংকে এখন ঋণ দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে। বাংলাদেশে করোনার প্রভাব শুরুর আগে গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চে অধিকাংশ ব্যাংকে আমানত সঙ্কট ছিল। ৯ থেকে ১০ শতাংশ সুদের আমানত পেতে মরিয়া ছিলেন ব্যাংকাররা। এসব ব্যাংক এখন ৬ থেকে ৭ শতাংশের বেশি সুদে আমানত নিচ্ছে না। এখন সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য বেড়েছে। এর পরও কোন ব্যাংক যেন সঙ্কটে না পড়ে সে জন্য সিআরআর বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমার হার দেড় শতাংশ কমিয়ে দেয়ায় ব্যাংকগুলোতে ১৮ হাজার কোটি টাকার ঋণযোগ্য তহবিল তৈরি হয়েছে। বাড়তি তারল্যের আলোকে ঋণ দিতে গিয়ে কোন ব্যাংক যেন সমস্যায় না পড়ে, সে জন্য সব ব্যাংকের ২ শতাংশ করে ঋণ দেয়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ ব্যাংক খাতের জন্য শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছে।

এদিকে বাজারে নগদ তারল্য সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় গত আগস্ট শেষে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অতিরিক্ত তরল্য দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার ৯৭৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এছাড়া প্রণোদনার ঋণে ভর করে বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা গতি ফিরছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ খাতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আগস্ট পর্যন্ত ছিল ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আর জুলাইয়ে ছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখনও শেষ হয়নি। এর মধ্যেই সবাই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এখন ব্যবসা আনা এবং বিতরণ করা ঋণ যেন সঠিক খাতে ব্যবহার হয়, ব্যাংকারদের তা কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন এবং নীতি-সহায়তার কারণে সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতের আমানত বাবদ খরচ কমেছে। এতে তারল্য নিয়ে ব্যাংকগুলো এখন স্বস্তিতে আছে।