বিদায়ী বছরে করোনার প্রভাবে অন্যান্য খাতের মতো বিপর্যস্ত ছিল পর্যটন খাত। মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর অচল হয়ে পড়ে দেশের সম্ভাবনাময় এ খাত। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের চলাচলে দেয়া হয় নিষেধাজ্ঞা। যাত্রী সঙ্কটে বন্ধ ছিল সব ফ্লাইট। বাতিল হয়ে যায় বাংলাদেশে আসা পর্যটকদের অগ্রীম হোটেল বুকিং, বিমান টিকিটসহ আনুষঙ্গিক সবকিছু। এর ফলে এ খাত সংশ্লিষ্ট লোকজন ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েন। বেকার হয়ে পড়েন অনেক শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। সংশ্লিষ্টদের দাবি, করোনা শুরুর প্রথম চার মাসেই এ খাতে ক্ষতি হয় ১৪ হাজার কোটি টাকা। কর্মহীন হয়ে পড়েন ৪০ লাখ লোক।
এর মধ্যে শুধু তারকা হোটেলেরই ক্ষতি ছাড়ায় ৭ হাজার কোটি টাকা। প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, করোনায় দেশে বেকার হয়ে পড়া হোটেল শ্রমিক ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায়৩ লাখ।
মহামারীর ধাক্কা লাগে ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর ব্যবসায়। প্রতিদিন লোকসান হয় শত কোটি টাকা। তারই মধ্যে অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। সম্ভাবনার এ খাত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ায়। হজ অ্যাজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)-এর দেয়া তথ্যানুযায়ী তাদের সদস্য সংখ্যা এক হাজার ২৩৮। ওমরাহ বন্ধ থাকা ও হজের অনুমতি না পাওয়ায় ওমরাহ ও হজ এজেন্সিগুলো সর্বসাকুল্যে ৬ হাজার ১২৫ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ব্যবসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার কর্মচারী বেকার হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় ৫ মাস পর গত আগস্টে খুলে দেয়া হয় দেশের পর্যটন কেন্দ্র। সামাজিক দূরত্ব বজায়ের পাশাপাশি মাস্ক ছাড়া কাউকে পর্যটন কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হবে না এই শর্তে সীমিত আকারে চালু হয় দেশের সব পর্যটন স্পট। এরপর থেকে দিনে দিনে মানুষের ঢল নামতে থাকে কেন্দ্রগুলোতে। ফলে নতুন করে আশার আলো জাগে এ খাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তাদের ধারণা, সামনে নানান কারণে ট্যুরিজম খাত যেমন ধীরে ধীরে চাঙ্গা হয়ে উঠবে তেমনি আরো নতুন কর্মসংস্থানেরও ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
ট্যুরিজম খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লকডাউনের পর কক্সবাজারসহ দেশের কিছু পর্যটন কেন্দ্র খুলে দেয়ার পর পর্যটকদের আগ্রহে তারা ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছেন। যদিও এখনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট স্বাভাবিক হয়নি। তারপরও শুধু দেশীয় পর্যটকদের ভিড় তাদের আস্থা বাড়িয়ে দিয়েছে। আর যখন বিদেশীদের আনাগোনা স্বাভাবিক হবে তখন ঘুরে দাঁড়াতে আর খুব সময় লাগবে না বলে তারা আশাবাদী।
এ দিকে পর্যটকদের বাংলাদেশের প্রতি আকৃষ্ট করতে নতুন বছরে পর্যটন ঘিরে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। আগামী বছর স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনে পর্যটনবর্ষ পালন করা হবে। পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে, সাত দিনব্যাপী ইনানীতে ৫০টি দেশের নৌবাহিনীর সাথে অনুষ্ঠান। অন্য দিকে ট্যুরিজম বোর্ডের একজন কর্মকর্তা জানান, বিগত ১০ বছরে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে সরকার কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে করে পর্যটকদের জন্য নতুন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বেড়েছে। এর মধ্যে শুধু কক্সবাজারে তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এগুলো হলোÑ সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। এতে প্রতি বছরে বাড়তি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রতি বছরে এতে বাড়তি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া প্রায় ৪০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এর বাইরে দেশে আন্তর্জাতিক মানের পাঁচ তারকা মানের হোটেল স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেটসহ অন্যান্য এলাকায় নতুন আরো ১০টি পাঁচ তারকা মানের হোটেল হবে। এতে আরো প্রায় ১০ হাজারের মতো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
কক্সবাজারের নাফ নদীর মোহনায় চালু হচ্ছে বিশ্বমানের পর্যটনকেন্দ্র। জালিয়ার দ্বীপ ঘিরে এই পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণ করছে থাইল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সিয়াম সিয়াম ইন্টারন্যাশনাল। প্রায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার (বাংলাদেশী প্রায় চার হাজার ২০০ কোটি টাকা) বিনিয়োগে এই মেগা প্রজেক্টের কাজ ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে। জানা গেছে, এটি হবে দেশের প্রথম দ্বীপভিত্তিক পর্যটনকেন্দ্র, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘নাফ ট্যুরিজম পার্ক’। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে তদারকি করছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতাস্মারক সই হয়েছে, যা ২০২১ সাল নাগাদ বাস্তবায়ন হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে প্রায় ৩০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।