‘এমপি লীগ’ ‘ভাই লীগ’ ‘লুটেপুটে খাওয়া লীগ’ নেতাদের কপাল পুড়ছে
এবার বিএনপি-জামায়াত-ফ্রীডম পার্টির নেতা-কর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া এমপি-মন্ত্রীদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। যারা নিজস্ব বলয় মজবুত করার মতলবে দলের দুঃসময়ের পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাদের হামলা-মামলায় কোণঠাসা করছেন। জার্সি বদল করে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ অনুপ্রবেশকারীদের বলয়ভুক্তির দ্বারা গড়ে তুলেছেন । নিজ দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে শায়েস্তা করতে গড়ে তুলেছেন ‘টর্চার সেল’। এই প্রভাবশালীদের লাগাম এখনই টেনে ধরতে চান দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবন ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা এবং দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশনা অমান্য করে যেসব এমপি-মন্ত্রী বা প্রভাবশালী নেতা নিজস্ব বলয় ভারী করতে জামায়াত-শিবির-বিএনপি, ফ্রিডম পার্টির লোকদের দলে (আওয়ামী লীগে) জায়গা দিয়েছেন তাদের তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। যাদের কারণে দুঃসময়ের আওয়ামী লীগ নিষ্ক্রিয় বা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দলীয় সম্মেলন কিংবা আগামী সংসদ নির্বাচনে দেবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।’
গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিতর্কিত এমপি-মন্ত্রী ও নেতাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ‘যেসব এমপি-মন্ত্রী স্বাধীনতাবিরোধী, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে হামলাকারী, অগ্নিসংযোগকারীদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে স্থানীয়ভাবে পদ-পদবি দিয়েছেন তাদের লিস্ট করা হচ্ছে। একইভাবে যেসব এমপি-মন্ত্রীর ছেলে-মেয়ে আত্মীয়স্বজন বেপরোয়া, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য, টিআর কাবিখা প্রকল্পে লুটপাট করছেন, লুটেপুটে খাওয়া বাহিনী গড়ে তুলে দলের দুঃসময়ের নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করে রেখেছেন তাদের তালিকা করা হচ্ছে।’ বিভিন্ন সংস্থা ও প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব টিমে এই তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে বলেও জানান তারা। সূত্রটি আরও জানায়, করোনাকালে অধিকাংশ সময় গণভবনে থাকছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনায় অর্থনীতি সচল রাখতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি তিনি এখন দল গোছাতে মনোযোগী। অনেক দিন আগেই তিনি বারণ করেছিলেন অন্য দলের নেতা-কর্মীকে আওয়ামী লীগে যোগদান যেন না করানো হয়। কিন্তু অধিকাংশ এমপি-মন্ত্রী বা নেতা দলীয় সভানেত্রীর বারণকে আমলে নেননি। গত বছর দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ তালিকা তুলে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। সে নির্দেশনাও এখন বাস্তবায়ন হয়নি। সে কারণে চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন বিএনপি-জামায়াত-ফ্রিডম পার্টির নেতা-কর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের ওপর। আওয়ামী লীগকে ‘আওয়ামী লীগ’র হাতে ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। যারা নিজস্ব বলয় প্রসারিত করতে ‘এমপি লীগ’, ‘ভাই লীগ’ গড়ে তুলে দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের দূরে ঠেলে দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। শাস্তি স্বরূপ যারা কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন, তাদের আগামী সম্মেলনে পদবঞ্চিত করা হতে পারে। আবার যারা এমপি-মন্ত্রী তারা আগামী সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতার এক যুগে জামায়াত-শিবির, বিএনপি, তালিকাভুক্ত রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সন্তান, ফ্রিডম পার্টি, জাতীয় পার্টি থেকে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ২ লাখের বেশি নেতা-কর্মী। এর মধ্যে প্রায় ৫৫ হাজার বিরোধী মতাদর্শী আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটিতে পদ-পদবিতে স্থান করে নিয়েছেন।
জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি, ফ্রিডম পার্টির নেতারা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে দল বদল শুরু করেন। ঢালাওভাবে হয়েছে ২০১৪ সালের পর এবং যা শাখা-প্রশাখায় বিস্তার লাভ করেছে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিরোধী এসব হাইব্রিড শুধু পদ-পদবিতেই শেষ নয়, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হয়েছেন অর্ধশতাধিক। সূত্র মতে, ঢাকা মহানগরে ১২ বছরে ১০ হাজারেরও বেশি বিরোধী মতাদর্শী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলায় ১২ বছরে প্রায় ২৭ হাজার বিভিন্ন দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে এসেছেন। রংপুর বিভাগের সাত জেলায় প্রায় ৩৫ হাজার নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে নতুন করে আওয়ামী লীগার হয়েছেন বিভিন্ন দলের কমপক্ষে ৩৮ হাজার নেতা-কর্মী। খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় প্রায় ২৮ হাজার এবং সিলেট বিভাগের চার জেলায় ১২ হাজার নেতা-কর্মী বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। বরিশাল বিভাগে প্রায় ১৮ হাজার নেতা-কর্মী বিভিন্ন দল থেকে এসেছেন। ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলায় বিরোধী মতাদর্শী ১৪ হাজার নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত দলীয় গ্রুপিংয়ে নিজ বলয় শক্ত করতে বিরোধী শিবিরের লোকজন ভিড়িয়েছেন প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা, এমপি-মন্ত্রীরা। হাইব্রিডদের নিয়ে তারা ১৯৯১ থেকে শুরু করে ২০০৮ সালের আগে যারা দলে সক্রিয় ছিলেন, ঝুঁকি নিয়েছেন তাদের শায়েস্তা করার মিশনে নেমেছেন। কিছু কিছু নির্বাচনী এলাকায় চলছে এমপি লীগের শাসন। ওইসব আসনে এমপির কথাই শেষ কথা। এর বাইরে নুন থেকে চুল খসলেই চলে হামলা-মামলা আর নির্যাতন। অনুপ্রবেশকারীদের দলে জায়গা দেওয়ার পাশাপাশি বিতর্কিত এসব এমপি-মন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় নেতাদের ছেলে, আত্মীয়স্বজনরাও অপকর্ম করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। বালু মহল, সরকারি পুকুর, সরকারি জায়গা দখল করা ছাড়াও গড়ে তুলেছেন লুটেপুটে খাওয়া বিশেষ লীগ বাহিনী। বিষয়টি দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আসায় এই বলয় ভাঙার নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের। সুদিন ফিরছে দুঃসময়ের কর্মীদের।
তৃণমূল নেতা-কর্মীরা বলছেন, কিছু কিছু এমপির কাছে তৃণমূলের ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের কদর নেই। হঠাৎ লীগই এদের পছন্দের তালিকা। ক্ষমতার এক যুগে জামায়াত-বিএনপির ব্যবসায়ী বা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে দলে ঢুকানো হয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগে এসেছেন এমন শিল্পপতি খ্যাত আওয়ামী লীগ নেতাদের দখলে এখন রাজনৈতিক মাঠ। এসব ব্যবসায়ী নেতা এখন দলের জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে আসীন। সারা দেশের প্রায় প্রতিটি সংসদীয় আসনজুড়েই এমন অবস্থা বিরাজ করছে। বিগত সময়ে সরকারবিরোধী বিভিন্ন নাশকতা মামলাসহ আওয়ামী লীগ কর্মী হত্যা মামলার আসামিও রয়েছেন।