দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত সর্ববৃহৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে খানিকটা দূরেই বাংলাদেশ-চীনের যৌথ মালিকানায় আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসতে যাচ্ছে। এ জন্য প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা এখন দিন-রাত কাজ করছেন। তারা জানান, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যবহার করা হচ্ছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নে এখন বাস্তবায়নের পথে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পটুয়াখালী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। সরকারি কোম্পানি রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে। আরপিসিএল চীনের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি নরিনকো ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
জানা যায়, এ প্রকল্প থেকে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য পড়বে প্রায় ৬ টাকার বেশি। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের ২৬.৫৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট (৬৬০ মেগাওয়াট) ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবং দ্বিতীয় ইউনিট (৬৬০ মেগাওয়াট) ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে উৎপাদনে আসার কথা। ৬ জানুয়ারি সরেজমিন প্রকল্প এলাকায় পরিদর্শন করে দেখা যায়, অধিগ্রহণকৃত ভূমির বিভিন্ন স্থানে অবকাঠামো নির্মাণকাজে ব্যস্ত দেশি-বিদেশি শ্রমিক। প্রকল্পের জন্য ধানখালীর নিশানবাড়িয়া ও লোন্দা মৌজায় ৯১৫.৭৪ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। করোনা মহামারীর কারণে প্রকল্পের কাজ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্মাণকাজ এখন অব্যাহত আছে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে চায়না এক্সিম ব্যাংক ১.৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ হিসেবে দেবে। চুক্তি অনুযায়ী চুক্তিমূল্যের ৩০% পর্যন্ত ব্যয় ইপিসি ঠিকাদার প্রাথমিকভাবে নিজেরাই বহন করবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি বয়লার, স্টিম টারবাইন এবং জেনারেটর নির্মাণের জন্য ইপিসি ঠিকাদারের মাধ্যমে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, যার অধিকাংশ ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের শেষ পর্যায়ে। চলতি বছরের মে থেকে পরবর্তী আট মাসের মধ্যে প্রধান যন্ত্রপাতিগুলোর ফ্যাক্টরি ইন্সপেকশন শেষ হবে। বর্তমানে পাইলিংসহ মালামাল হ্যান্ডলিং জেটি, একসেস রোডসহ প্রকল্পের অফিস ও আবাসন সুবিধাদির নির্মাণকাজ চলছে। বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি অনুযায়ী এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ ২৫ বছর ধরা হয়েছে। তবে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এ কেন্দ্র থেকে ৪০-৫০ বছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
জানা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে প্রতিদিন প্রায় ১২ হাজার মেট্রিক টন কয়লা প্রয়োজন হবে। এ জন্য ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আমদানি করা হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে সর্বাধুনিক আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে। এতে পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার পরিমাণ কম। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ২২০ মিটার উঁচু চিমনি ব্যবহারের ফলে কেন্দ্রটির ছাই বা ধোঁয়া পরিবেশের ওপর কম নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে আরও থাকছে অ্যাশপন্ড, যার ৯৯ ভাগ ফ্লাইঅ্যাশ বয়লার টিউবের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে। কয়লা পরিবহনের জন্য প্রকল্পটির পাশে জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। অর্থাৎ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো একই ব্যবস্থায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্রেও কয়লা আসবে। আর বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) নির্মাণ করবে এর গ্রিডলাইন।
প্রকল্প পরিচালক মো. তৌফিক ইসলাম বলেন, ‘পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা আমরা এই প্রকল্পেও ব্যবহার করছি। এই প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে অসন্তোষ যাতে তৈরি না হয় এ জন্য সতর্ক ছিলাম। এ ছাড়া শ্রমিকদের প্রকল্প এলাকার ভিতরই বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণ সবচেয়ে জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ভূমি অধিগ্রহণের ফলে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনে ৩০ একর ভূমিতে দৃষ্টিনন্দন আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। এর আওতায় ২৮১টি বাড়ি, মসজিদ, স্কুল, ক্লিনিক, দোকান, কমিউনিটি সেন্টার, সাইক্লোন শেল্টার, খেলার মাঠ, কবরস্থান, পুকুর ইত্যাদির নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে বাড়িঘর হস্তান্তর করা হবে। এমনকি প্রকল্প এলাকায় যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাদের নিয়ম অনুযায়ী তিনগুণ দাম দেওয়া হয়েছে। আর প্রকল্পটি থেকে বেশ কিছু দূরে ক্ষতিগ্রস্তদের থাকার জন্য তৈরি করে দেওয়া হয়েছে পাকা ঘর। এ প্রকল্পের পুনবার্সনের জন্য পাকা ঘর পাচ্ছেন এমন একজন রানী আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই আমরা এখানে থাকছি। প্রকল্প এলাকায় নতুন ঘর করে দেওয়ায় আমরা খুশি। এ ছাড়া চাষের জমি বাবদ আমাদের ভালো অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি জানান, তার স্বামীও বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় কাজ করে জীবিকা উপার্জন করছেন।
আরপিসিএলের নির্বাহী পরিচালক সেলিম ভূঁইয়া বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ আইন পরিবর্তন হওয়ায় অধিগ্রহণে সময় বেশি লাগে। আর আরপিসিএল কর্তৃপক্ষ তাদের দায়বদ্ধতা থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের আবাসনসহ অন্যান্য সুবিধার ব্যবস্থা করেছে। আশা করা হচ্ছে চলতি বছরের মার্চের মধ্যে পুনর্বাসন এলাকার সব কাজ শেষ হবে। প্রকল্পের ইপিসি কর্ডিনেটর লি ফুডং বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের অন্যতম বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেই নির্মাণ করছি এটি। পরিবেশগত ঝুঁকি কমাতে আন্তর্জাতিক সংস্থার নির্দেশনা মেনে কাজ করছি।’