একাত্তর সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সারা বিশ্বের বিস্ময় ও আকাশসম শুভকামনা নিয়ে জন্মেছিল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। পাহাড়সম বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে এবং দেশে-বিদেশে ক্রিয়াশীল বৈরী শক্তির মোকাবিলা করে বাংলাদেশের টিকে থাকা এবং বিপুল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মাঝে দৃষ্টিনন্দন আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি অর্জন যে একটি বিস্ময়কর চমক তার সাফল্যগাথা রয়েছে বেশুমার। শুরুতেই বলে রাখা ভালো, জাতির পিতার অকুতোভয়, গতিময়, উদ্ভাবনী ও প্রত্যয়ী নেতৃত্ব যেমন দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে তেমনি তার অর্থনৈতিক মুক্তির আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিষান-কিষানি ও শ্রমজীবী মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অসাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারী শিল্প উদ্যোক্তাদের সৃষ্টিকুশলতা মিলেই আজকের বাংলাদেশের অর্থনীতির মজবুত অবস্থান ও দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার চলার পথ।
বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট ২০১৩ অনুসারে : নতুন একটি উদ্যোগ করার সূচকে ২০১২ সালের ৯৫তম স্থান থেকে বাংলাদেশ ২১টি ঘর অতিক্রম করে ২০১৩ সালে ৭৪তম স্থানে উঠে এসেছে। নিবন্ধন ও লাইসেন্সপ্রাপ্তি প্রক্রিয়া সহজীকরণ, অটোমেশন এবং কর ও মূল্য সংযোজন কর বিষয়ে ইতিবাচক সংস্কারের ফলে এ অগ্রগতি। বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে যে, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে চমৎকার সাফল্য লাভ করেছে; যার ফলে দেশে এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা শতকরা ২৬ ভাগ। ফলে ২০১৫ সালের বেঁধে দেওয়া জাতিসংঘের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্টের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এগিয়ে রয়েছি আমরা।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের দ্য গ্লোবাল কমপিটেটিভ রিপোর্ট ২০১৩-১৪ অনুযায়ী বাংলাদেশ গেলবারের তুলনায় আটটি ঘর ওপরে এসে ১১০তম স্থানে রয়েছে। অনুরূপভাবে জাতিসংঘের কর্মসূচি, ইউএনডিপি কর্তৃক ২০১৩ সালের মানবসম্পদ উন্নয়ন রিপোর্টে বলা হয়েছে, “Bangladesh’s HDI value for 2012 is 0.515… Between 1980 and 2012, Bangladesh’s life expectancy at birth increased by 14 years, mean years of schooling increased by 2.8 years, expected years of schooling increased by 3.7 years and GNI per capita increased by about 175 percent”. ওই রিপোর্টে মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের অগ্রগতি বজায় রাখতে পারায় সন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির ভিন্ন ধারার একটি সূচকে মুডিসের প্রত্যয়ন হচ্ছে : বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনে স্থিতিশীলতার কারণে গত এক দশকে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। অনুরূপভাবে স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুয়োরস (এসএন্ডপি) কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের ঋণমানকে ভারতবর্ষের কাছাকাছি এবং ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার সমতুল্য বিবি বলে উল্লেখ করে যাচ্ছে। ২০১৩ সালের লন্ডনভিত্তিক লিগেটাম সমৃদ্ধির সূচক অনুসারে ২০০৯ সালে ১০৭ নম্বরে থাকা বাংলাদেশ ১০৩ নম্বর স্থানে উঠেছে ২০১৩ সালে। ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান বিশ্ব অর্থনীতির ওই দুর্যোগের মহামন্দাকালে পিছিয়ে পড়ে যথাক্রমে ১০৬ ও ১৩২ নম্বরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের ইতিবাচক সিঁড়ি ভাঙার সোপান হয়েছে সামগ্রিক সমৃদ্ধি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (+৪), উদ্ভাবনী উদ্যোগ (+২), সুশাসন (+১৮), স্বাস্থ্যসেবা (+৫), শিক্ষা (+১), নিরাপত্তা (+৫) ও সামাজিক মূলধন সৃষ্টির (+৩) ক্ষেত্রে। সাম্প্রতিককালে দ্য ইকোনমিস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ানসহ বিশ্বের অনেক প্রকাশনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিস্ময়কর এবং ইহাকে ‘এশিয়ার বাতিঘর’ হিসাবে উল্লেখ করেছে।
বর্তমান শতাব্দীতে সুপেয় জলের সমস্যা সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যাগুলোর অন্যতম বলে স্বীকৃত। বাংলাদেশ এবং জালালাবাদ অঞ্চলে এ সমস্যা প্রকট হচ্ছে। লোয়ার রিপারিয়ন দেশ বিধায় বাংলাদেশের পানি সমস্যায় বহুমাত্রিকতা বিদ্যমান : পানীয়, সেচ, মৎস্য চাষের আধার, জলবিদ্যু, পর্যটনশিল্পের উপকরণ, যাতায়াত, বন্যা, খরা ইত্যাদি। এহেন মহামূল্যবান পানিসম্পদ আহরণ, সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও বৃদ্ধিকল্পে আজ হোক কাল হোক, দেশের উত্তর-পশ্চিমের কোনো একটি স্থান, কুড়িগ্রাম, চিলমারী অথবা রৌমারী থেকে শুরু করে দেশের সীমানার অভ্যন্তরে ২৫০ কিলোমিটার দূরত্বে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ পর্যন্ত মিসরের আসোয়ান ড্যামের অনুরূপে একটি বিপুলাকার বাঁধ নির্মাণ করে বর্ষার পানি ধরে রাখা বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে অপরিহার্য। ওই ভৌগোলিক অঞ্চলে যেসব নদীতে (পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, তিস্তা, সোমেশ্বর, সুরমা, বরাক ইত্যাদি) উজান থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত সেগুলোর খনন ও একই প্রকল্পের অংশ হিসাবে সংযুক্ত করা ভালো হবে। বন্যা নিরোধক বাঁধ হিসাবে ওই ড্যাম ব্যবহৃত হবে; তার চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হবে (ক) সুপেয় পানি সরবরাহ (খ) সেচের জলাধার সৃষ্টি (গ) মৎস্য চাষক্ষেত্র (ঘ) পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প (ঙ) রাস্তার ধারে গাছপালার মাধ্যমে পরিবেশ সুস্থকরণ ও জলবায়ুতে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং (চ) দ্রুততর যান চলাচলের ব্যবস্থা। বাংলাদেশের একটি সম্পূর্ণ স্বনির্ভর গতিময় প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি সৃষ্টির স্বার্থেই প্রস্তাবিত সোনার বাংলা মেগা প্রকল্পের সমীক্ষা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুরু করা সমীচীন হবে।
লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর