দেশে একের পর এক নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এবং পরবর্তীতে এর স্থির ও ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা বিচ্ছিন্নভাবে ঘটলেও এর বেশিরভাগেরই ‘ট্রেন্ড’ (প্রবণতা) একই রকম। তাই এটি কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা এবং কোনো অপশক্তি এর পৃষ্ঠপোষকতা করছে কিনা, সেটা নিয়ে সন্দিহান গোয়েন্দারা। এ ছাড়া ধর্ষণ-নির্যাতনের প্রতিবাদে সাধারণ মানুষের বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকে পুঁজি করে বিশেষ কোনো গোষ্ঠী দেশজুড়ে বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা। এই পরিস্থিতিতে সারাদেশে পুলিশকে সতর্ক অবস্থান নিতে পুলিশ সদর দপ্তর কঠোর নির্দেশ দিয়েছে।
একই সঙ্গে ধর্ষণ-নির্যাতনের মতো অপরাধের যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে এবং এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট অপরাধীরা যাতে কোনোভাবে পার পেয়ে যেতে না পারে, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ তৎপর হওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনাকে পুঁজি করে কেউ কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রের নীল নকশা তৈরি করছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখার তাগিদ দিয়েছে পুলিশের শীর্ষ প্রশাসন।
অপরাধীরা যাতে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার ভিডিও ফেসবুক, টুইটারসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহজে ছড়িয়ে দিতে না পারে, এ জন্য পুলিশ সদর দপ্তরের ল-ফুল ইন্টারসেপশন সেল (এলআইসি), ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল (সিসিটিসি) ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ, অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি)
সাইবার পুলিশ সেন্টার, পুলিশ বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবংর্ যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের র্(যাব) সাইবার অপরাধ তদন্ত-বিষয়ক সেলকে তীক্ষ্ণ নজর রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে থানা পুলিশ যাতে সাইবার অপরাধী শনাক্ত ও ভিকটিমদের তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান দিতে পারে, সে লক্ষ্যে থানায় তথ্যপ্রযুক্তির লজিস্টিক সাপোর্ট ও আইটিতে দক্ষ নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
নির্দেশনায় ধর্ষণ-নারী নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের চিহ্নিত করে দ্রম্নত আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি ভিকটিম ও তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত মামলা তদন্তে পুলিশের কোনো ধরনের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, নোয়াখালীতে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও একের পর এক ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে গত সোমবার থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালীসহ দেশের অন্যান্য জেলা শহরে সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশের যে কর্মসূচি শুরু হয়েছে, তা আরও কয়েকদিন চলমান থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সুযোগে ষড়যন্ত্রকারী কোনো গোষ্ঠী ওই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে সেটা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার সুযোগ নিতে পারে। তাই নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে আয়োজিত প্রতিটি কর্মসূচি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখতে সারাদেশে পুলিশকে সতর্ক থাকা জরুরি। কেননা; এই সময় আন্দোলনকারীদের আড়ালে থাকা ষড়যন্ত্রকারীরা কোনো ধরনের উস্কানি দিয়ে পুলিশকে উত্তেজিত করে তুলতে পারে।
চলমান পরিস্থিতিতে পাড়া-মহলস্নায় নতুন করে কোনো অঘটন এবং এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে যাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে না পারে, এ জন্য পুলিশের কার ও ফুট পেট্রল বাড়ানো হয়েছে।
পুলিশের ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, ধর্ষণ-নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেছে। ক্ষমতাসীন দলীয় কেউ এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে, তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণেও কোনো ধরনের দ্বিধা করা হবে না বলেও প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সাফ জানান দিয়েছেন। সরকারের নীতিনির্ধারক মহল থেকেও এ ব্যাপারে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় তাদের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়া সহজ হবে।
দায়িত্বশীল ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ধর্ষণ-নারী নির্যাতনের ঘটনায় থানায় মামলা করতে গিয়ে ভিকটিম ও তার পরিবারের হয়রানির শিকার হওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। তাই মাঠপর্যায়ের পুলিশকে এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ভিকটিম মামলা না করলেও কোনো মাধ্যমে ধর্ষণ-নির্যাতনের খবর পাওয়া গেলে বিষয়টি তাৎক্ষণিক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে।
বিশ্বের অনেক দেশেই যৌন অপরাধে অভিযুক্তদের তালিকা করে তদারক করে স্থানীয় প্রশাসন। এ ব্যবস্থায় যেমন অপরাধ ঠেকানোর পাশাপাশি অপরাধীদের কাউন্সিলিং করার সুযোগ থাকে। অথচ দেশে যৌন অপরাধীদের তালিকা না থাকায় এবং তাদের নজরদারিতে না রাখায় ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন মামলার অনেক আসামি জামিনে বের হয়ে আবার একই অপরাধ করছে। তাই থানা পর্যায়ে এ ধরনের অপরাধীদের তালিকা তৈরির ব্যাপারেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ধর্ষণ-নারী নির্যাতনকারীদের একটি বড় অংশ মাদকাসক্ত হওয়ায় মাদক পাচার এবং এর যথেচ্ছা ব্যবহার রোধেও পুলিশকে তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
উপরমহলের নির্দেশনা পাওয়ার কথা স্বীকার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা জোনের এক ওসি বলেন, নৈতিক অবক্ষয়ে ধর্ষণ বেড়েছে। অথচ রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে অনেক সময় ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে উপরমহল থেকে এখন যে নির্দেশনা পাওয়া গেল, এতে এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে।
এদিকে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য পরোক্ষভাবে পুলিশকেই দুষছেন। তাদের ভাষ্য, এ ধরনের ঘটনার পর পুলিশ দ্রম্নত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এবং সঠিক তদন্তসাপেক্ষে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের আইনের হাতে তুলে দিলে তাদের কঠোর সাজা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো। এতে এ ধরনের অপরাধ অনেকাংশে কমে যেত।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সালমা আলী ব্র্যাকের একটি গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেন, ৯৯ শতাংশ ধর্ষণ মামলার আসামিদের কোনো শাস্তি হয় না। এ কারণে নারীরা ধর্ষিত হওয়ার পর মামলা করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখান না। তেমনি পুলিশও এ ধরনের মামলা নিতে চায় না। আবার মামলা হওয়ার পর ‘নারীবান্ধব’ তদন্ত না হওয়ারও নজির রয়েছে। আসামিদের সঙ্গে পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের যোগসাজশ থাকলে ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
এ ছাড়া ধর্ষণ মামলার আলামত ও প্রমাণ দ্রম্নত নষ্ট হয়ে যায়। অথচ তদন্তকারীরা সেগুলো যথাযথ সংরক্ষণ করেন না। ভিকটিম ও সাক্ষী সুরক্ষার অভাবে অনেকে সাক্ষ্য দিতে আদালতে যান না। ফলে আসামিরা সহজে পার পেয়ে যায়।