দুর্গম চরে আশার আলো

admin
জানুয়ারি ১৮, ২০২১ ১:১৯ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

বর্তমান সরকার দেশে দ্রুতগতিতে শতভাগ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে দেশের প্রত্যন্ত ও দুর্গম চরাঞ্চলেও পৌঁছতে শুরু করেছে বিদ্যুতের আলো। অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে দেশের যেসব চর এলাকায় যুগের পর যুগ বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি এবার বিদ্যুৎ বঞ্চিত সেই এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে শুরু করেছে। নদ-নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিদ্যুতের লাইন। বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হচ্ছে একের পর এক চরাঞ্চল। দেশ স্বাধীনের ৫০ বছরের মাথায় দুর্গম এসব এলাকার মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে আশার আলো।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)-এর দায়িত্ব প্রাপ্তদের দেওয়া তথ্যে, দেশের অফগ্রিড এলাকার ১ হাজার ৫৯টি গ্রামের মধ্যে ২৯টি গ্রামবাদে ১ হাজার ৩০টি গ্রাম গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত হবে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে। আর ২৯টি গ্রামকে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে সংযুক্ত করা সম্ভব হবে না। কারণ এই গ্রামগুলো বড় এবং সেখানে ১০-২০ কি.মি. এলাকাজুড়ে ৫ থেকে ১০ জন করে মোট ৬ হাজার গ্রাহক আছে। যাদের অনেকে আবার চর এলাকায় বছরের একটি সময়ে পানিতে ভাসেন। এই গ্রাহকদের ঘরে সৌর বিদ্যুতের সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হবে। এসব গ্রামে ৩০ ওয়াট, ৫০ ওয়াট ও ৭৫ ওয়াট করে সোলার বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এরই মধ্যে সৌর বিদ্যুতের টেন্ডার কাজ শেষ হয়েছে। দুই-এক মাসের মধ্যে তারাও বিদ্যুৎ পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। যেহেতু দেশে সাবমেরিন ক্যাবল তৈরি করে একমাত্র বিআরবি, বাকিগুলো আসে চীন থেকে। আর এই ক্যাবল আনতে কিছুটা সময় লাগছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, অনগ্রিড এলাকায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের পর এখন অফগ্রিড এলাকা যেমন- দুর্গম পাহাড় ও চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে এখন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। একসময় যেসব চর এলাকায় বিদ্যুৎ পাওয়া মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো ছিল তা এবার পূরণ হতে চলেছে।
বিআরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈনউদ্দিন (অব.) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের ১ হাজর ৫৯টি গ্রাম, উপজেলা রাঙ্গাবালিসহ মোট ২২টি সমিতি আছে যেখানে চরাঞ্চল আছে। এর অধিকাংশই রাঙ্গাবালি ও ভোলায় পড়েছে। এ দুর্গম স্থানগুলোতে আড়াই লাখ গ্রাহক আছে। এই মানুষগুলোকে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য নদীর এপার-ওপার ৮ হাজার কি.মি. ওভারহেড লাইন বসানো হবে। আর মাঝখানে নদীতে থাকবে ৮৫টি ক্রসিং পয়েন্ট। আর নদীর ওপারে লাইন নিয়ে সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে ১৮টি সাবস্টেশন থাকবে। এই অবকাঠামোগুলোর কাজ প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এখন শুধু ৮৫টি পয়েন্টে সাবমেরিন ক্যাবল লে করার কাজ বাকি আছে। সাবমেরিন ক্যাবলগুলো অনেকটাই এসে গিয়েছে। বাকিগুলোও আসছে। আমরা আশা করছি চলতি বছরের জুনেই সব অফগ্রিড এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ সম্পন্ন হবে। এই কাজ আরইবির নিজস্ব অর্থায়নে হবে। যার প্রকল্প মূল্য ৩০০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে আরইবির সরকারি অর্থায়নে দুটি শতভাগ প্রকল্পও রয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে, ভোলা এবং পটুয়াখালীর দুর্গম ১৬টি চরের কয়েক লাখ মানুষের বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। ভোলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে অফগ্রিড এলাকার এসব চরের মানুষের জন্য সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ পেতে যাচ্ছেন ৩৭ হাজারের বেশি গ্রাহক। ভোলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি তাদের অফগ্রিড এলাকার ১৬টি চরের মানুষের সঙ্গে নিয়মিত উঠান বৈঠকের মাধ্যমে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করছেন। ভোলার মধ্যে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর বিচ্ছিন্ন ১৬টি চরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কাজ চলছে। জানা যায়, মেঘনা নদীর তলদেশ দিয়ে ভোলার তুলাতলী থেকে মাঝের চরে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে এই বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে। সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ করা হচ্ছে জেলা সদরের কাঁচিয়া মাঝের চর, দৌলত খান উপজেলার মদনপুর, মেদুয়া, ভবানীপুর চর, চরবোরহান, তজুমদ্দিন উপজেলার চর মোজাম্মেল, মলনচর, চরফ্যাশন উপজেলার কুকরি-মুকরী, চরবিশ্বাস, চর কাজল, চর মন্তাজ, মুজিবনগর, আন্দার চরসহ মোট ১৬টি চর। মূলত ৭টি পয়েন্ট থেকে এই সংযোগগুলো হচ্ছে। এ জন্য ১০১ কি.মি. সাবমেরিন ক্যাবল নদী পথে স্থাপন করা হবে আর ১ হাজার ২৫৩ কি.মি. লাইন গ্রিডে হবে। প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে খরচ হবে ৭৫ হাজার টাকা। এই সংযোগের ফলে মেঘনা, তেঁতুলিয়া ও সাগর মোহনের সব জেলে পল্লী বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় আসবে।
এ ছাড়া ফরিদপুরের পদ্মার চর অঞ্চলের মানুষের মাঝে রীতিমতো উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর বিদ্যুৎ পেতে যাচ্ছে এই এলাকার মানুষজন। দুর্গম এই চরের ১০ হাজারের বেশি পরিবার এবার বিদ্যুতের আলোয় নিজের ঘর আলোকিত করার সুযোগ পাবেন। ফরিদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি তাদের অফগ্রিড এলাকা পদ্মার চরে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুতায়নের কাজ শুরু করেছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল বড় নৌকায় করে সেই এলাকার চরের ঘাটে এখন ভিড়ছে।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ও চিলমারী ইউনিয়নের প্রায় ১৫০ বছর পুরনো দুর্গম চরাঞ্চল। এখানকার কয়েকটি গ্রামে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ বাস করেন। ভারত সীমান্ত ঘেঁষা এসব গ্রাম পদ্মা নদীর কারণে মূল ভূখ- থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। বিদ্যুৎ পাওয়া এই অঞ্চলের মানুষের কাছে ছিল অনেকটা স্বপ্নের মতো। গত ৩ জানুয়ারি এই ২টি ইউনিয়নেও বিদ্যুতের আলো পৌঁছে গিয়েছে। এই চরাঞ্চল এলাকায় ২২১টি সংযোগের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া শুরু হয়েছে। এখানে পদ্মা নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে লাইন নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর দুই ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৮ হাজার পরিবার বিদ্যুতের আওতায় আসবে। এ ছাড়াও গত বছরের শেষে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার কচিকাটার দুর্গমচরে ২১টি গ্রামের এক হাজার ৬৮ জন গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ উদ্বোধন করা হয়। এই চরেও সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালি উপজেলা, রাজশাহী, লালমনির হাটের চরাঞ্চলে ও নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবল টেনে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড।