রাজধানীর মেট্রোরেল লাইন-৬-এর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। দিয়াবাড়ী থেকে মিরপুর অংশে বসানো হচ্ছে রেলট্র্যাক, যার ওপর দিয়েই চলবে ট্রেন। এ অংশে টানা হচ্ছে বৈদ্যুতিক লাইন। এগিয়ে চলেছে স্টেশন নির্মাণের কাজও। ঋণ পরিশোধসহ পরিচালন ব্যয় মেটাতে দিনে ২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে চাইছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। তাদের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মাসে পরিচালন ব্যয় হবে ৬৯ কোটি ৯১ লাখ ৭২ হাজার ২২৯ টাকা। দৈনিক ব্যয় হবে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৫ হাজার ৭৪১ টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ বাবদ ১ কোটি ৫৩ লাখ ৮৮ হাজার ৪৮৫ ও সরকারের ব্যয় জোগাতে লাগবে ৪৯ লাখ ৯১ হাজার ১৮৫ টাকা। অর্থাৎ ২ কোটি টাকার বেশি যাবে শুধু জাইকার ঋণ ও সরকারের ব্যয় পরিশোধে। এই পুরো টাকা টিকেট বিক্রির মাধ্যমে আয় করতে চাইছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।
মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ কমিটির প্রাক্কলন অনুযায়ী, দিনে ৪ লাখ ৮৩ হাজার যাত্রী মেট্রোরেল ব্যবহার করবে। সে হিসাবে ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ৪০ পয়সা হিসাবে ৪৮ টাকা ২৫ পয়সা। তবে যাত্রী এর চেয়ে কম হলে পরিচালন ব্যয় ওঠাতে ভাড়া বাড়াতে হবে। সম্প্রতি ভাড়া নির্ধারণ কমিটির সভা থেকে এ প্রস্তাব করা হয়। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে এটা চূড়ান্ত হবে। তবে ভাড়া আরও বাড়তে পারে বলে জানা গেছে।
মেট্রোরেল পরিচালনায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ দিনে ১৩ লাখ ৯ হাজার ৭১৭ টাকা প্রয়োজন হবে। অন্যান্য প্রশাসনিক খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ১১ হাজার ৬৮৫ টাকা। মেট্রোরেলের রক্ষণাবেক্ষণে দিনে ৭ লাখ টাকার প্রয়োজন হবে। ট্রেন পরিচালনায় দিনে বিদ্যুৎ বাবদ ৬৭ হাজার ৯৮৫ টাকা খরচ হবে। বিদ্যুতের বর্তমান দাম ধরে এ হিসাব করা হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে ভাড়াও বাড়াতে হবে। অন্যান্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৭৯৩ টাকা।
মেট্রোরেল আইন-২০১৫ অনুযায়ী, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) নির্বাহী পরিচালকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি রয়েছে ভাড়া নির্ধারণে। পরিচালন ব্যয় বিশ্লেষণ করে কমিটি ভাড়া প্রস্তাব করেছে। দৈনিক ২ কোটি ৩৩ লাখ ৫ হাজার ৭৪১ টাকা ব্যয় মেটাতে ৪ লাখ ৮৩ হাজার যাত্রী হলে কিলোমিটারে ২ টাকা ৪০ পয়সা ভাড়া নিতে হবে। ভাড়া নির্ধারণ কমিটির প্রধান ডিটিসিএ’র নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রাকিবুর রহমান জানান, তারা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া প্রস্তাব করেছেন। মন্ত্রণালয় তা যাচাই-বাছাই করবে। ভাড়া চূড়ান্ত করবে সরকার। তা প্রস্তাবিত ভাড়ার চেয়ে কম বা বেশি হতে পারে। মেট্রোরেল আইন ২০১৫-এর ১৮(২) অনুযায়ী, পরিচালন ব্যয় ও জনসাধারণের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় ভাড়া নির্ধারণ করা হবে।
২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চলছে। আগামী বছরে এর একাংশ চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রকল্প ব্যয়ের ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। বাকি ৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা জোগান দিচ্ছে সরকার। উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে চলছে স্টেশন তৈরির কাজ। বসানো হচ্ছে রেলট্র্যাক আর জাপানে তৈরি হয়ে রয়েছে রেলকোচ। ঢাকায় আসতে শিপমেন্টের প্রহর গুনছে রেলকোচ। আশা করা হচ্ছে, আগামী এপ্রিলেই দেশে আসবে এসব রেলকোচ। সে মাসেই টেস্ট রান শুরু করতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই মেট্রোরেল লাইন-৬-এর কাজ এগিয়ে নিচ্ছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
ডিএমটিসিএল কর্মকর্তারা জানান, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আগামী ১৬ ডিসেম্বর দেশের প্রথম মেট্রোরেল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে চলেছে প্রকল্পের কাজ। তবে এপ্রিলে পরীক্ষামূলকভাবে চলবে মেট্রোরেল। উত্তরার তিনটি স্টেশনে ট্রায়াল রানের পরিকল্পনা থাকলেও আরও দুটি বাড়িয়ে সংযুক্ত করা হবে মিরপুরকেও। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক জানান, উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্ট্রাল এবং উত্তরা দক্ষিণÑ এই তিনটি স্টেশন নিয়েই ট্রায়াল রান করার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি, এটাকে বাড়িয়ে মিরপুর পর্যন্ত ট্রায়াল রান করার। তা হলে শহরের মধ্যে মানুষ ট্রেনগুলো দেখতে পারবে। এ লক্ষ্যে উত্তরার প্রথম তিনটি স্টেশনের পুরো কাজ দ্রুত শেষ করা হচ্ছে।
মেট্রোরেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মোট ১৬টি স্টেশনের প্রতিটির কাজই এখন চলমান। এর মধ্যে প্রথম পাঁচটি প্লাটফর্মের অবকাঠামো শেষ। আর বাকিগুলোরও পিলার বসে গেছে। গত ডিসেম্বরেই প্রথম লটের পাঁচটি রেলকোচ জাপানে তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রকল্পের ৫২ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। তবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে অগ্রগতি প্রায় ৭৮ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্ধিত সময় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হওয়ার সম্ভাবনা তেমন একটা নেই। করোনার সময় প্রথম কয়েক মাস কাজের গতি কম থাকায় মেট্রোরেলের ২০ কিলোমিটারের সম্পূর্ণ অংশ চালুর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছে। এক্ষেত্রে স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তিতে ১৬ ডিসেম্বর দেশের প্রথম মেট্রোরেলের সম্পূর্ণ অংশের পরিবর্তে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর মতিঝিল পর্যন্ত চালু করতে আরও এক বছর সময় লাগতে পারে বলে প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।