‘জঙ্গীমুক্ত দেশ’ গঠন করতে প্রায় সাড়ে তিন শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। এই পরিকল্পনার আওতায় কারাগারে আটক জঙ্গীদের ‘ডি-র্যাডিকালাইজেশন’ (চরমপন্থা থেকে ফিরিয়ে আনা) উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। পুলিশ কারা কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে নেয়া হয়েছে এই পরিকল্পনা। কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে কারাগারে আটক জঙ্গীদের মানসিকতার পরিবর্তন করে চরমপন্থী থেকে ফিরিয়ে আনাই হচ্ছে উদ্যোগের উদ্দেশ্য। ক, খ ও গ-এই তিন ক্যাটাগরিতে কাউন্সিল করার জন্য প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে জঙ্গী সদস্যদের। দেশে জঙ্গী সদস্যদের কাউন্সিলিং করার এত বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করার ঘটনা এই প্রথম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের কারাগারগুলোতে রয়েছে সহস্রাধিক জঙ্গী সদস্য। এর মধ্যে অনেক দুর্ধর্ষ জঙ্গী রয়েছে, যারা কারাগারের ভেতর থেকেও বাইরের জঙ্গীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। এসব জঙ্গীদের কারাগারের ভেতরে সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখা সম্ভবপর হচ্ছে না। সম্প্রতি কারগারের জঙ্গী হামলা চালিয়ে জঙ্গী ছিনিয়ে নেবে এমন গোপন তথ্যের ভিত্তিতে কারাগারগুলো সতর্ক ব্যবস্থা নিয়েছে। অনেক কারাগারে স্টাইকিং ফোর্স নিয়োগ করা হয়েছে। আবার কারাগার থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে অনেক জঙ্গীই আর আদালতে হাজির না হয়ে পুনরায় জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ছে। পুলিশের জঙ্গীবিরোধী অভিযানে জঙ্গীদের গ্রেফতারের কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু জঙ্গীবাদ দমন হচ্ছে না। এ জন্যই জঙ্গীদের কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। জঙ্গীদের সংশোধন করার উদ্যোগ সফল হলে তারা কারাগারের ভেতর থেকে বাইরের জঙ্গীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে না, কারাগারে জঙ্গী হামলার হুমকি, আশঙ্কার মতো কোন ঘটনা থাকবে না, এমনকি যেসব জঙ্গী জেল থেকে ছাড়া পাবে তাদের সমাজে পুনর্বাসিত করা গেলে জঙ্গীবাদ ক্রমশ: নির্মূল হয়ে যাবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর নিকটবর্তী বুড়িগঙ্গার ওপার ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার ও গাজীপুর জেলার কাশিমপুর কারাগারসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে সহস্রাধিক কারান্তরীণ রয়েছে সহস্রাধিক জঙ্গী সদস্য। কারাগারে আটক এসব জঙ্গীদের যারা ভয়ঙ্কর জঙ্গী তাদের ‘ক’ ক্যাটাগরি, অপেক্ষাকৃত কম ভয়ঙ্করদের ‘খ’ এবং যারা নবীন তাদের ‘গ’ ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। কারাগারে আটক জঙ্গীরা যাতে জেল জীবনের পর আর জঙ্গীবাদে না জড়ায় সেই লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে কাউন্সেলিং করার এই পরিকল্পনা। সামাজিক সচেতনতা, আলেম ওলামাদের সমন্বয়ে জঙ্গীবিরোধী জনসচেতনতাসহ নানাভাবে জঙ্গীদের রাশ টেনে ধরে জঙ্গীবাদকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়েই রাখার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর নেয়া হয়েছে জঙ্গীদের কাউন্সিল করার এই প্রকল্প।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে জঙ্গী সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ও জঙ্গী তৎপরতা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে ২০০৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা করা হয় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে। সৌভাগ্যক্রমে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও ৩ শতাধিক আহতের ঘটনা ঘটানো হয়। এর আগে রমনা বটমুলে বোমা হামলা, পল্টনে সিপিবির জনসভায় বোমা হামলাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বোমা হামলায় বিপুলসংখ্যক মানুষজন হতাহত হন। এমনকি সারাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হতাহতে ঘটনা ঘটানো হয়। ২০০৭ সালে তৎকালীন শীর্ষ জঙ্গী শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ শীর্ষ জঙ্গীদের ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে জঙ্গীবাদের মিশন শেষ হয়ে গেছে বলে তৎকালীন সরকার মনে করেছিল। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও জঙ্গী প্রশ্নে অনেকটা হাল ছেড়ে দেয়। কিন্তু জঙ্গীরা ২০০৭ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সময়ে নিজেরা ঠিকই সংগঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের স্লিপারসেল সদস্যরা ২০১৩-২০১৬ পর্যন্ত সময়ে একের পর ব্লগার হত্যা করে। এসব হত্যার পর পুলিশ কিছুটা নড়ে চড়ে বসলেও কাজের কাজ হয়নি। জঙ্গীরা ভেতরে ভেতরে নিজেদের নেটওয়ার্ক আরও বিস্তৃত করেছে। ফলে ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশান হলি আর্টিজানে হামলা করে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এতে বহির্বিশ্বে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পাশপাশি বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকেল্পর আওতায় অবস্থানরত কমপক্ষে ৫ বিদেশী নিজ দেশে চলে যায়। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সারাদেশে জঙ্গীবিরোধী অভিযান পরিচালনা শুরু করা হয়। র্যাব পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ৯ মাস্টারমাাইন্ড জঙ্গীসহ শতাধিক জঙ্গী নিহত এবং গ্রেফতার করা হয় সহস্রাধিক জঙ্গীকে। জঙ্গী সংগঠনগুলোর মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। জিরো টলারেন্স দেখিয়ে জঙ্গীবিরোধী অভিযান পরিচালনায় এখন অনেকটাই জঙ্গী মুক্ত বাংলাদেশ করতে সক্ষম হয়েছে সরকার। সরকার এখন মনে করছে জঙ্গীবাদকে যে কোন মূল্যে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কারণ জঙ্গীরা চরমপন্থায় বিশ্বাস করে। তারা ইসলামী মতবাদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গীবাদের নতুনদের উজ্জীবিত করে। এরপর তাদের মাসের পর মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং কাউন্সেলিং (ব্রেনওয়াশ) করে মাঠে নামায়। সুতরাং সরকারও এখন এই পথে হাঁটার উদ্যোগ নিচ্ছে। যাকে বলে কাটা দিয়ে কাটা তোলা। কারণ শুধু অভিযান পরিচালনা করে গ্রেফতার করে জঙ্গীবাদ নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার বলে মনে করেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, কারাগারে কাউন্সেলিং ও সাজাভোগ শেষে জঙ্গী সদস্যদের পুনর্বাসনেরও উদ্যোগ রয়েছে পুলিশ সদর দফতরের। জঙ্গীদের ফিরিয়ে আনতে হবে সঠিক পথে এবং তাদের পুনর্বাসন করে সমাজে প্রতিষ্ঠার পথ দেখাতে হবে। নতুবা জঙ্গী সদস্যরা আবারও জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনের কাজ ত্বরান্বিত করতে একটি ‘প্রতিরোধ কেন্দ্র’ স্থাপন করে সেখানে জঙ্গীদের মানসিকতা পরিবর্তনে কাজ করানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়তে সরকার সাড়ে তিন শ’ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের আওতায় জঙ্গীদের ডি-র্যাডিকালাইজেশনের (চরমপন্থা থেকে ফিরিয়ে আনা) কার্যক্রমের মধ্যে সামাজিকভাবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম অন্যতম। আপাতত পুলিশ সদর দফতর থেকে এ কার্যক্রম পরিচালিত হলেও প্রতিরোধ কেন্দ্রের জন্য রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে ১৩ তলা ভবন নির্মাণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। শেরে বাংলা নগরে ১৩ তলা ভবন নির্মিত হলে যেখান থেকে এসব কার্যক্রম পরিচালিত হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রচার চালানো হবে। পুনর্বাসনের জন্য ট্রেনিং ওয়ার্কশপ ও সেমিনার করা হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন তদন্ত কেন্দ্রের জন্য বিভিন্ন ধরনের ২৭ সেট যন্ত্রপাতি ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম কেনা হবে। এছাড়াও এই কেন্দ্রের জন্য প্রিজনভ্যান, এক্সপ্লোসিভ অর্ডানেন্স ডিসপোজাল ভ্যান ও আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ারসহ (এপিসি) কিছু যানবাহনসহ ও আনুষাঙ্গিক সরঞ্জাম কেনা হবে।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গীবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। যেটা বাংলাদেশেও কমবেশি আছে। কিন্তু বাংলাদেশ জঙ্গীবাদ নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে সফলতার পরিচয় দিয়েছে। যা ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এবং প্রশংসীত হয়েছে। অবশ্য এ নিয়ে উচ্ছ্বাসে গা ভাসালে চলবে না। আমাদের লেগে থাকতে হবে। জঙ্গীবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। জঙ্গীরা কি করছে, তৎপরতা, পরিকল্পনা, মোটিভেশন, ট্রেনিং কাউন্সেলিংসহ সব বিষয়েই নজরদারি চলছে। যাতে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা জঙ্গীরা আবারও সংগঠিত হতে না পারে। আমরা এবার যে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি আশা করছি বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। আমাদের এ অর্জন আমাদেরই ধরে রাখতে হবে। আমরা বলতে আমি শুধু পুলিশ বাহিনীর কথা বলছি না। র্যাব আছে, বিজিবি আছে, এসবি সিআইডি ডিবি, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসার আলেম ওলামা, সাংবাদিক যারা জঙ্গী নিয়ন্ত্রণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের সবার সমন্বয়ে কঠিন কাজটাকে আমরা সহজে করতে সক্ষম হয়েছি। এটাকে খাট করে দেখার বিষয় নয়। মুক্তিযুদ্ধের পর জঙ্গীবাদ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে বৃহত্তম অর্জন। যা আমরা এখনও টের পাচ্ছি না। জঙ্গীবাদ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এতদিন দেশের বিনিয়োগ কমে যেতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতো। সতরাং জঙ্গীবিরোধী গোয়েন্দা নজরদারি ও অব্যাহত অভিযানের পাশপাশি আমরা মনে করি জঙ্গীদের কাউন্সেলিংটাও দরকার। যাতে তারা কারাগারে থাকা অবস্থায় নিজেদের ভুল বুঝতে পারে নিজেদের সংশোধন করতে পারে এবং কারাভোগ শেষে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে এমনটাই আশাবাদ ব্যক্ত করেই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।