ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা ও চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়ন্ত্রণসহ আর্থিক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্র মোহনায় বাস্তবায়নাধীন সরকারের অন্যতম মেগা প্রকল্প বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে এটি বাস্তাবায়নের কথা ছিল। কিন্তু ভারত-চীনসহ বেশকিছু প্রভাবশালী দেশ এটি নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে এবং বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে নতুন পরিকল্পনা করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৩টি টার্মিনালের ১টি চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ (চবক) এককভাবে এবং অপর দুটি বিল্ড-অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার (বিওটি) ভিত্তিতে নির্মিত হবে। চবকের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান দেশ রূপান্তরের কাছে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এম. শাহজাহান বলেন, পিপিপিতে বে-টার্মিনাল হলে পুরোটাই বিদেশিদের পরিচালনায় ও নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। চবক কেবল বছরান্তে কিছু ফী পেত এবং আমাদের বন্দরটা মরে যেত। বিওটিতে এটা হবে না। এতে চবকের নিয়ন্ত্রণ ও অংশীদারিত্ব থাকবে এবং ২০-২৫ বছর পর (চুক্তি মোতাবেক) এই বন্দর পুরোপুরি আমাদের হয়ে যাবে। তাই ভূ-রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় নিয়ে সরকার বে-টার্মিনালের দুটি টার্মিনাল বিওটি ভিত্তিতে নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এবং এজন্য, সিঙ্গাপুর-পোর্ট অথরিটি (পিএসএ) এবং ডি.পি ওয়ার্ল্ডকে (দুবাই) তাদের আগ্রহপত্র বিস্তারিত প্রস্তাব আকারে দাখিল করতে বলেছে।
বন্দর সূত্র জানা যায়, বর্তমান বন্দর থেকে ১৮ নটিক্যাল মাইল (৩৩ কি.মি.) গভীরে অবস্থিত এই টার্মিনাল নির্মিত হলে ১২ মিটার গভীরতা সম্পন্ন বৃহদাকার জাহাজ (মাদার ভ্যাসেল) ভিড়তে পারবে। যেখানে বর্তমান বন্দরে জোয়ারের সময় সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারে। ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার প্রাক্কলন ব্যয়ের এই মেগা প্রকল্পটি সরকার প্রথমে পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা করে। এতে চীন, ভারত, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর পোর্ট অথরিটি (পিএসসি) ও দুবাইভিত্তিক ডি.পি ওয়ার্ল্ডসহ অনেকগুলো দেশ ও প্রতিষ্ঠান আগ্রহ প্রকাশ করে। সরকার এদের মধ্য থেকে ৮টি দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করে। প্রত্যেকেই সর্বোচ্চ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু ভারত ও চীন এই প্রকল্প নির্মাণকে কেন্দ্র করে অতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
বন্দর সূত্র জানায়, বিবদমান ভারত-চীন দুই দেশই চাইছিল এটি নির্মাণ করতে। এর অন্যতম কারণ ছিল বঙ্গোপসাগরের আধিপত্য বিস্তার। এটি নির্মাণ করতে পারলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্দরে চীনের একটি আধিপত্য থাকবে। অন্যদিকে ভারত কোনোভাবেই চাইছিল না, চীন বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করুক। তাই ভারত এটি নির্মাণ করার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী ছিল। উভয় দেশের পক্ষে একে অপরকে কাজ দেওয়ার বিষয়ে চাপও ছিল। এছাড়া পিপিপির মাধ্যমে এটি নির্মিত হলে সেখানে সরকার কেবল হিস্যা পাবে। কিন্তু কর্তৃত্ব থাকবে বাস্তবায়নকারী দেশের হতে। তাই বাধ্য হয়ে অর্থায়ন পরিকল্পনায় সরকার পরিবর্তন আনছে। এছাড়া বে-টার্মিনালটি নির্মিত হওয়ার পর কম গভীরতা সম্পন্ন বর্তমান বন্দরটি যাতে নিষ্প্রাণ না হয় সেজন্য চবক এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে।
বর্তমানে দেশে বড় জাহাজগুলো প্রবেশ করতে পারে না। এগুলো বহির্নোঙরে (আউটার অ্যাঙ্করেজ) নোঙর ফেলে রাখা হয়। সেখান থেকে ছোট জাহাজে (লাইটারেজ ভ্যাসেল) করে বন্দরে এনে খালাস করা হয়। এতে ৭-১০ দিন অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয়। এতে বাড়তি যে ব্যয় হয় তার পুরোটাই ব্যবসায়ীদের বহন করতে হয়। খুচরা ভোক্তা পর্যন্ত এর চাপ পড়ে। এ থেকে উত্তরণে ২০১১-১২ অর্থবছরে বে-টার্মিনাল নির্মাণের সমীক্ষা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) করা হয়। বর্তমান চেয়ারম্যান তখন বন্দরের সদস্য (অপারেশন) ছিলেন।
এরপর দীর্ঘ এক দশক কেটে গেলেও এ বিষয়ে কোনো পরামর্শক নিয়োগ করা হয়নি। গত মাসে বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব নিলে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ সম্পর্কিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে তিনি জানান, পিপিতে বে-টার্মিনাল হলে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম গতি হারাতে পারে। এজন্য, বে-টার্মিনালে বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে অন্তত একটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা দরকার। বাদবাকি দুটি টার্মিনাল চবকের নিয়ন্ত্রণ রেখে ২০ বা ২৫ বছরের জন্য বিদেশি স্বনামধন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বিওটি ভিত্তিতে করা যেতে পারে।
চবক চেয়ারম্যান দেশ রূপান্তরকে বলেন, সবাই (ভারত-চীন) কাজটা করতে চায়। সরকার সেক্ষেত্রে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে। আমরা অর্থনীতিটা বুঝি। বন্দরের স্বার্থ তথা জাতীয় স্বার্থরক্ষা করতে চাই। সে জন্যই, পিপিপি পরিহার করে এবং একটি টার্মিনাল নিজেদের জন্য রেখে বাকি দুটি বিওটি ভিত্তিতে নির্মাণ করতে চাই। চবকের তহবিলে বর্তমানে ৭ হাজার কোটি টাকারও অধিক ব্যাংকে জমা আছে। বে-টার্মিনাল নির্মাণে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা সম্ভব নয়। তাই, আমরা কারও মুখাপেক্ষী না হয়েই বে-টার্মিনাল নির্মাণ করতে পারি। বিদেশি কোম্পানি কাজ পেলে তারা নিজেদের টাকায় এটা করবে না বরং ওরা বিশ^ব্যাংক থেকে লোন নেবে। প্রয়োজন হলে আমরাও তা নিতে পারি।
তিনি আরও বলেন, পিএসএ ও ডি.পি ওয়ার্ল্ড (দুবাই) কর্র্তৃপক্ষ শিগগিরই তাদের প্রস্তাব বন্দর কর্র্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করবে। অতঃপর তা যাচাই-বাছাই ও সংশোধনী সাপেক্ষে এই দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বন্দরের এস্টেট অফিসার জিল্লুর রহমান দেশ রূপান্তরকে জানান, পতেঙ্গা সমুদ্র উপকূলের হালিশহর ইপিজেড থেকে রামনাবাদ জেলেঘাট পর্যন্ত সোয়া ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় এলাকাজুড়ে প্রস্তাবিত বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রাথমিক কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ৬৪ একর ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এবং বাদবাকি ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অনুমোদন সাপেক্ষে শিগগিরই সম্পন্ন করা হবে।
বে-টার্মিনাল নির্মাণের ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক ও বন্দরের নির্বাহী প্রকৌশলী রাফিউল আলম জানান, প্রকল্পের ডিজাইন ও প্রাক্কলন ব্যয়সহ যাবতীয় কাজে কনসালট্যান্ট নিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এই কাজ সম্পন্ন হলে বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রকৃত ব্যয় নির্ধারণ করা যাবে। তবে তিনি উল্লেখ করেন এক দশক আগের সমীক্ষায় বে-টার্মিনাল নির্মাণে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার প্রাক্কলন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমানে এই ব্যয় ৩ বিলিয়ন ডলার বা আরও কিছু বেশি হতে পারে।
সবকিছুর আগে হবে সমুদ্র শাসন বাঁধ : বে-টার্মিনাল নির্মাণের বিষয়ে চবক চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার বাসভবনে একান্তে আলাপ করেন এই প্রতিবেদক। তখন তিনি জানান, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত থেকে কিছুটা ডানদিকে পশ্চিম-উত্তর কোন বরাবর বিদ্যমান মেরিন ড্রাইভ ঘেঁষে (যেটি চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের ফৌজদারহাটে যুক্ত) প্রস্তাবিত বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়া এখন গতিশীল। ইতিমধ্যে, প্রয়োজনীয় জমি হুকুম দখলের কাজটি প্রায় সম্পন্ন করে এনেছে জেলা প্রশাসন। বর্তমানে সেখানে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণের কাজ চলছে। চবক নিশ্চিত করেছে, এই প্রতিরক্ষা দেয়াল এমনভাবে নির্মাণ করা হবে যাতে কোনোভাবেই শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়।
এ বিষয়ে চবক চেয়ারম্যান বলেন, ‘জলাবদ্ধতার প্রশ্নই আসে না; বরং শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা সহায়ক কিছু করছি।’ তিনি সমুদ্র উপকূলে বে-টার্মিনাল নির্মাণ ও তা বড় জলোচ্ছ্বাসে সুরক্ষায় একটি শক্তিশালী ‘সি ওয়াটার ব্র্যাক ড্যাম’ সর্বাগ্রে নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দেন এবং বলেন, সবার আগে বাঁধ, তারপর টার্মিনাল।
তিনি বলেন, উপকূলের যেখানটায় বে-টার্মিনাল নির্মাণ হবে তার সম্মুখে একটি স্রোত প্রবহমান, আর তার অনতিদূরে একটি লম্বাটে চর জেগে আছে। আমরা বিদ্যমান প্রবাহিত স্রোত ড্রেজিং করে তার কাদামাটি দিয়ে সম্মুখের চরটিকে উঁচু ও সুরক্ষিত ‘সি ওয়াটার ব্র্যাক’ হিসেবে ব্যবহার করব। এই বাঁধের দৈর্ঘ্য হবে ১০ কিলোমিটার এবং প্রস্থে তা হবে এক থেকে দেড় কিলোমিটার। আর বাঁধটি ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা মাথায় রেখে ৩৫ ফুট উচ্চতায় নির্মাণ করা হবে। সেই সঙ্গে সমুদ্রের দিকে বাঁধে উন্নত প্রযুক্তির সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ১০ কি.মি. দীর্ঘ ও দেড় কি.মি. প্রশস্ত এই বাঁধে হাজার হাজার ফলদ, বনজ গাছের চারা রোপণ করা হবে। পর্যটকদের ভ্রমণ, বসা, বেড়ানো ও আলোকসজ্জার সুবন্দোবস্ত করা হবে। বাঁধের বাইরের দিকে লাইটারেজ জাহাজগুলো নোঙর করে থাকতে পারবে। আর, তা পর্যটকদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ হয়ে উঠবে।
নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, জাহাজ ভেড়ানো হবে টার্মিনালে। সি ওয়াটার ব্র্যাক ড্যাম তার থেকে বহুদূরে হবে। সেখানে যেতে হবে নৌকায় বা স্পিড বোটে; তীর থেকে বাঁধ পর্যন্ত কোনো সংযোগ ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে না, পর্যটকরা ওই বাঁধে বসে গভীর সমুদ্র অবগাহনের আমেজ পাবেন। এরপাশেই একটি শক্তিশালী নেভাল বেইসও স্থাপন করা যেতে পারে, যেটি সামরিক কৌশলগত দিক থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা ও বিদেশি জাহাজের নিরাপত্তা বিধানে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
বে-টার্মিনাল বাস্তবায়িত হলে তা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে উল্লেখ করে চবক চেয়ারম্যান বলেন, এটা বর্তমান সরকার ও দেশের ব্যবসায়ী মহলের একটি স্বপ্ন। আমি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের এক কা-ারি হিসেবে কাজ করছি। এই টার্মিনালে ১২ মিটার গভীরতা ও ৩শ মিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজ দিবারাত্রি ভেড়ানো যাবে। একেকটি জাহাজ কমপক্ষে ৫ হাজার টিইইউ’স (২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে একক) কন্টেইনার বহন করবে। এতে, কন্টেনাইরের ভাড়া প্রতি এককে ২ হাজার ডলার থেকে ১ হাজার মার্কিন ডলারে নেমে আসবে। তাতে, স্বাভাবিক কারণেই জাহাজ ভাড়া হ্রাস পাবে। এতে, আমদানি ব্যয় হ্রাস পেয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় ঘটবে। বন্দরে জাহাজ জট কমবে এবং সময়ের সাশ্রয় হবে। যা পণ্যমূল্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং সামগ্রিকভাবে জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাবে।
চবক চেয়ারম্যান আরও বলেন, বে-টার্মিনালের একটি টার্মিনাল, যেখানে তিনটি বৃহদায়তন জাহাজ একসঙ্গে ভেড়ানো যাবে। জোয়ার-ভাটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। জাহাজগুলো বে-টার্মিনালের দক্ষিণ দিক থেকে টার্মিনালে প্রবেশ করে উত্তরের চ্যানেল দিয়ে বেরিয়ে যাবে। কিংবা উভয়পথ ব্যবহার করতে পারবে। পিএসএ ও ডি.পি ওয়ার্ল্ড নির্মাণ করলেও এটির নিয়ন্ত্রণ ও বাৎসরিক হিস্যা পাবে চবক।