বিশে^র অনেক দেশে গণতন্ত্রের পরিসর সঙ্কীর্ণ হলেও বাংলাদেশ গণতন্ত্র সূচকে চার ধাপ এগিয়েছে। ২০২০ সালে ৫ দশমিক ৯৯ গড় স্কোর অর্জন করে ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৭৬তম স্থানে উঠে এসেছে। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আছে তৃতীয় অবস্থানে। তবে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতিকে ৫ ভাগে ভাগ করে বাংলাদেশ ‘মিশ্র শাসনে’ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
বুধবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, সারাবিশে^ করোনাকালে মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা ও স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ দেওয়ায় গণতান্ত্রিক সূচকে বড় ধরনের অধঃপতন হয়েছে, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। তবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বজায় রাখায় বাংলাদেশে সামান্য অগ্রগতি হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালের এই সূচকে বিশে^র মোট জনসংখ্যার অর্ধেক (৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ) এখন গণতন্ত্র অথবা আংশিক গণতন্ত্র ভোগ করছে। এর মধ্যে পূর্ণ গণতন্ত্র উপভোগ করছে মাত্র ৪ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) মূলত পাঁচটি মানদণ্ডে একটি দেশের গণতন্ত্র পরিস্থিতি বিচার করে বুধবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। সেখানে বাংলাদেশের চার ধাপ উন্নতি করে ৫ দশমিক ৯৯ স্কোর অর্জন করে ৭৬তম স্থানে উঠে এসেছে। গত বছর এই সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫ দশমিক ৮৮, আট ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ উঠে এসেছিল ৮০তম অবস্থানে। তার আগের বছর ৫ দশমিক ৫৭ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ তালিকার ৮৮তম অবস্থানে ছিল।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০০৬ সালে যখন প্রথম এই সূচক প্রকাশ করে, তখন বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৬ দশমিক ১১। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালে তা এক ধাক্কায় ৫ দশমিক ৫২ পয়েন্টে নেমে যায়। তারপর থেকে ২০২০ সালেই গণতন্ত্র সূচকে সবচেয়ে বেশি স্কোর পেয়েছে বাংলাদেশ। গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের চার ধাপ অগ্রগতিকে বেশ ইতিবাচকভাবে দেখছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ফেরদৌস হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র আরও সুসংহত হয়েছে। যার কারণে গণতন্ত্র সূচকে চার ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। গণতান্ত্রিক ধারার এ অগ্রগতি গত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে গত তিন বছরে ৮৮তম অবস্থান থেকে ৭৬তম অবস্থানে নেমে আসা ভালো দিক।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, কোনো দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুসংহত হলে সে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও মজবুত হয়। তাই দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য গণতন্ত্রের উন্নতি হওয়া দরকার। বাংলাদেশ চার ধাপ এগুলে সেটি অবশ্যই দেশের জন্য ইতিবাচক দিক। অন্যদিকে ২০২০ সালে এই সূচকে পুরো বিশে^র গড় স্কোর আগের বছরের ৫ দশমিক ৪৪ থেকে কমে ৫ দশমিক ৩৭ হয়েছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বলছে, ২০০৬ সালে সূচক প্রকাশের পর থেকে এটাই সবচেয়ে বাজে স্কোর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশে^র গণতন্ত্রের দশার এই অবনমনের পেছনে মহামারির মধ্যে দেশে দেশে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টি বড় ভূমিকা রেখেছে।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বলছে, গণতন্ত্রের জন্য এই বাজে বছরেও বাংলাদেশ, ভুটান ও পাকিস্তানসহ এশিয়ার কিছু দেশের স্কোরে উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তারপরও বিশে^র এক-তৃতীয়াংশ মানুষ রয়ে গেছে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে, যার একটি বড় অংশ চীনের বাসিন্দা।
নির্বাচনি ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, সরকারের সক্রিয়তা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক অধিকারÑ এই পাঁচ মানদণ্ডে একটি দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ১০ ভিত্তিক এই সূচক তৈরি করে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। সব সূচক মিলিয়ে কোনো দেশের গড় স্কোর ৮-এর বেশি হলে সেই দেশে ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ রয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। স্কোর ৬ থেকে ৮ এর মধ্যে হলে সেখানে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’, ৪ থেকে ৬ এর মধ্যে হলে ‘মিশ্র শাসন’ এবং ৪ এর নিচে হলে সে দেশে ‘স্বৈরশাসন’ চলছে বলে ধরা হয়।
প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালে তাদের ভাষায় ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ ছিল মাত্র ২৩টি দেশে, যা আগের বছরের চেয়ে একটি বেশি। ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ রয়েছে এমন দেশের সংখ্যা আগের বছর থেকে দুটি কমে ৫২টি হয়েছে। আর ‘মিশ্র শাসনে’ আছে এমন দেশ ৩৭টি থেকে কমে ৩৫টি হয়েছে।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বিচারে বর্তমান বিশে^ ৫৭টি দেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীনে রয়েছে; এই সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে তিনটি বেশি। এবারের সূচক বলছে, গণতন্ত্রের বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে ভারত। ৬ দশমিক ৬১ স্কোর নিয়ে ভারত আছে তালিকার ৫৩ নম্বরে। এরপর ৬ দশমিক ১৪ স্কোর নিয়ে শ্রীলঙ্কা ৬৮তম; ৫ দশমিক ৯৯ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ ৭৬তম; ৫ দশমিক ৭১ স্কোর নিয়ে ভুটান ৮৪তম; ৫ দশমিক ২২ স্কোর নিয়ে নেপাল ৯২তম; ৪ দশমিক ৩১ স্কোর নিয়ে পাকিস্তান ১০৫তম; ৩ দশমিক ০৪ স্কোর নিয়ে মিয়ানমার ১৩৫তম এবং ২ দশমিক ৮৫ স্কোর নিয়ে আফগানিস্তান ১৩৯তম অবস্থানে রয়েছে।
৯ দশমিক ৮১ স্কোর নিয়ে এবারের তালিকার শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে। শীর্ষ দশে আরও আছেÑ আইসল্যান্ড, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নেদারল্যান্ডস। ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য ও জার্মানি পূর্ণ গণতন্ত্রের দেশের তালিকায় থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের স্থান হয়েছে গতবারের মতোই ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের’ দেশের তালিকায়।
এই ভাগের ৫২ দেশের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কা। আর বাংলাদেশকে এই প্রতিবেদনে রাখা হয়েছে মিশ্র শাসনের দেশের তালিকায়, যেখানে ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তানসহ ৩৫টি দেশ রয়েছে। তালিকার তলানিতে আছে উত্তর কোরিয়া। এ ছাড়া ডিআর কঙ্গো, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, সিরিয়া, চাঁদ ও তুর্কমেনিস্তানকেও নিচের দিকে রাখা হয়েছে।