খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে ॥ ধান-নদী-খালবেষ্টিত অঞ্চল বরিশাল। সাগর বিধৌত ও নদী বেষ্টিত বরিশাল বিভাগের সঙ্গে একসময় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই অনুন্নত। সড়ক পথে ফেরি পারাপার ছিল বিড়ম্বনার। নৌপথেও যাতায়াতে আধুনিক ব্যবস্থা ছিল না। আকাশ পথও ছিল বিচ্ছিন্ন। আর রেল গাড়ি? তা স্বপ্নেও ভাবেননি দক্ষিণাঞ্চলবাসী।
এসবের কারণে অবজ্ঞার চোখে দেখা হতো বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসীকে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বিএনপি দীর্ঘদিন সরকারে থাকা ও এ অঞ্চলে বিএনপির প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি, এমনকি রাষ্ট্রপতি থাকলেও বরাবরই দক্ষিণাঞ্চল ছিল অবহেলিত। সেই অবহেলিত মানুষের কাছে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তে অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলে এখন অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
ইতোমধ্যে বরিশালসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ৯০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে, পায়রা সমুদ্রবন্দরে পণ্য ওঠানামা করছে, পায়রা বন্দরের অদূরে লালুয়া ইউনিয়নে এক হাজার একর আয়তনের এলাকা ঘিরে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুত উৎপাদন শুরু হয়েছে। বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় দেশের দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল নেটওয়ার্কের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বরিশালে নির্মিত হয়েছে শেখ হাসিনা সেনানিবাস, গড়ে উঠছে আইসিটি পার্ক (হাইটেক পার্ক), বিমান বাহিনীর রাডার কেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার ও অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। এছাড়া দেশের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য বরিশালের হিজলা উপজেলার হিজলা-গৌরবদী ইউনিয়নের মেঘের চর নামক এলাকাকে প্রস্তাব রাখা হয়েছে। নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর কল্যাণে সরাসরি রেলপথ যাবে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা হয়ে বরিশাল দিয়ে পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত। পর্যায়ক্রমে এ কাজ শেষ করা হবে। রেললাইন নির্মাণের জন্য সরকার থেকে নেয়া হয়েছে ব্যাপক পরিকল্পনা। ইতোমধ্যে অধিকাংশ উপজেলাকে শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আনা হয়েছে। বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের সর্বত্রই লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। এর মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে উন্নয়নের মাধ্যমেই অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে শুরু করেছে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে।
পায়রা সমুদ্রবন্দর আর কুয়াকাটার পর্যটন শিল্পকে ঘিরে বর্তমান সরকারের সময়ে শুরু হওয়া মেগা প্রকল্পের কর্মযজ্ঞ অতীতে কল্পনাও করেননি এ অঞ্চলের মানুষ। সারাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় এককালের অবহেলিত বরিশাল বিভাগের সর্বত্র উন্নয়নের জোয়ারে বদলে যেতে শুরু করেছে।
উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চলমান বৃহৎ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। এতে করে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ মাথাপিছু আয়ের শহর হবে বরিশাল। চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের অব্যাহত অগ্রগতিতে একসময়ের অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলকে ঘিরে এখন সারাদেশের আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। আর এ আগ্রহের নেপথ্যে কাজ করছেন স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সুনজরে মহামারী করোনার মধ্যেও ধারাবাহিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।
সূত্র মতে, ১৯৯৬ সালে তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুয়াকাটাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বরিশাল তথা দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে ঘিরে উন্নয়নের নানা পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় কুয়াকাটার সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের জন্য আওয়ামী লীগের গত আমলে কলাপাড়া, হাজীপুর এবং মহিপুরের ফেরির পয়েন্টে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এসব সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে দ্রুতগতিতে এসব সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর ২০১৮ সালে তিনটি সেতু সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রায় শেষের পথে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে লেবুখালীর পায়রা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের কাজ। এ সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে বরিশাল কুয়াকাটার সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে আর কোন ফেরি থাকবে না।
একইসঙ্গে করোনার মধ্যেও মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে সেতুটির ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। অতিসম্প্রতি পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি বলেছেন, পদ্মা সেতুর ৮১ শতাংশেরও বেশি এবং মূল সেতুর প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, শেখ হাসিনার সরকার বিগত দশ বছরে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য সর্ববৃহৎ অর্থ বরাদ্দ দিয়ে বড় বড় মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে কাজ শুরু করেছে। সরকারের এসব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর বরিশাল শুধু এগিয়েই যাবে না, চলে যাবে সামনের কাতারে। পর্যটনে কুয়াকাটা তথা বরিশাল হবে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
অপরদিকে বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে চলাচল করছে বিলাসবহুল অত্যাধুনিক নৌযান। কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত সময়ে বরিশাল-ঢাকা আকাশ পথে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান ছাড়াও চলাচল করছে বেসরকারী ইউএস বাংলা এবং নভো এয়ারের বিমান।
শুধু তাই নয়, দ্রুত কুয়াকাটা এবং পায়রা বন্দরকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের মধ্যে আনার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার জন্য গত বছরের ১১ অক্টোবর একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূমি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন করেছেন।
শেখ হাসিনা সরকারের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়নে চলমান প্রকল্প ছাড়াও প্রস্তাবিত বরিশালের আগৈলঝাড়া ও ভোলায় বিশেষ অর্থনৈতিক জোন, ভোলা-বরিশাল সেতু, পাইপ লাইনের মাধ্যমে ভোলার গ্যাস বরিশালে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে বরিশাল বিভাগজুড়ে ব্যাপক হারে গড়ে উঠবে দেশী-বিদেশী শিল্প প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয় দেখার বিরল সুযোগ রয়েছে জাপানে। ঠিক একই সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায়। সাগর কন্যা কুয়াকাটায় এখন উন্নতমানের অসংখ্য হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্ট হয়েছে। যে কোন পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়াতে পারছেন কুয়াকাটায়।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে, বেড়ানো ছাড়াও এখন কুয়াকাটাকে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যার অন্যতম শাপলাপাতা মাছ প্রক্রিয়াজাত (শুঁটকি) এবং মৌসুমি ফল তরমুজ বিদেশে রফতানি করা হয়।
শুধু পর্যটনই নয়, বাংলাদেশের তৃতীয় বাণিজ্যিক সমুদ্রবন্দর হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে পায়রা। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে এই সমুদ্রবন্দরটি দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চিত্র বদলে দেবে। পাশাপাশি মাদার ভেসেল নোঙ্গরের সুবিধাসহ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের চেয়েও আধুনিক মানের হিসেবে গড়ে তুলতে পায়রা সমুদ্র বন্দরের বিভিন্ন অংশের নির্মাণ কাজ চলছে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের রাবনাবাদ চ্যানেলের সামনে। অপরদিকে পায়রা বন্দরে কন্টেনার টার্মিনাল, এলএনজি টার্মিনাল, বাল্কহেড টার্মিনাল, শিপইয়ার্ড, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ কাজে চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। বরিশাল চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আলহাজ সাইদুর রহমান রিন্টু জনকণ্ঠকে বলেন, চট্টগ্রাম এবং মংলা সমুদ্রবন্দরে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাস করতে হয় বহির্নোঙ্গরে। রাবনাবাদ চ্যানেল অনেক গভীর হওয়ায় পায়রা সমুদ্র বন্দরে সরাসরি পণ্য খালাস করতে পারবে মাদার ভেসেলগুলো। এতে পণ্য আমাদানি ও রফতানিতে পরিবহন খরচ অনেক কমবে। বরিশালে শিল্প কলকারখানা ও গার্মেন্টস হলে কম খরচে শ্রমিক পাওয়া যাবে। উৎপাদন ব্যয়ও কমবে। তিনি আরও বলেন, দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হওয়ার পর পায়রা বন্দরকে ঘিরে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চল হবে সিঙ্গাপুরের চেয়েও সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অঞ্চল।
পায়রা সমুদ্রবন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, যখন একটি বন্দর গড়ে ওঠে, তখন সেই বন্দরকে ঘিরে অনেক কলকারখানা ও গার্মেন্টস স্থাপন, আমদানি, রফতানিসহ ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হয়ে উঠে এটাই স্বাভাবিক। ফলে এই বন্দর বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্দরের অদূরে লালুয়া ইউনিয়নে এক হাজার একর আয়তনের এলাকাকে ঘিরে চলছে কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের কাজ। বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রথম পর্যায়ের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এখন চলছে মূল কেন্দ্র নির্মাণের কাজ। এখানেও কাজ করার সুযোগ পাবেন অসংখ্য শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা। বিদ্যুত প্রকল্পকে ঘিরে আন্দারমানিক নদীর তীরেও চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ।
বরিশালের কৃতী সন্তান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও শিক্ষানুরাগী এ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার জনকণ্ঠকে বলেন, উচ্চশিক্ষার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বরিশালে রয়েছে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আলাদা মহিলা ও পুরুষ টেকনিক্যাল ট্রেনিং কলেজ (টিটিসি), মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং মেরিন একাডেমি। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। সবকিছু মিলিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বরিশালেই রয়েছে সবধরনের ব্যবস্থা।
বরিশালের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর মোঃ হানিফ জনকণ্ঠকে বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই শিক্ষায় অগ্রগামী ছিল বরিশাল। তারই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বরিশালে যুগোপযোগী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েছে।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেয়া ব্যাপক উন্নয়নের মহাযজ্ঞে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের সর্বত্রই এখন উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। এতে মহাখুশি দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দারা।
মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ আরও বলেন, চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের অব্যাহত অগ্রগতিতে একসময়ের অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলকে ঘিরে এখন সারাদেশের আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। আর এ আগ্রহের নেপথ্যে কাজ করছেন স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সুনজরে ধারাবাহিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। যে কারণে চলমান প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের পর এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন বয়ে আনবে।
উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চলমান উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হলে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের মতো বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ মাথাপিছু আয়ের শহর হবে বরিশাল। এমনিতেই সিঙ্গাপুরের মতো আলাদা নির্ভরতা রয়েছে বরিশালের। পাশাপাশি আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় অগ্রাধিকারের সমৃদ্ধ অর্থনীতি পাবে বৃহত্তর বরিশাল বিভাগের ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলাও।
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দুইবারের জনপ্রিয় সাবেক সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস জনকণ্ঠকে বলেন, সিঙ্গাপুর একদিনে এমন হয়নি। একসময় মালয়েশিয়া তাদের বের করে দিয়েছে। তাদের নেতা লি কুয়ানের অদম্য প্রচেষ্টায় মাত্র ৭৩০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সিঙ্গাপুর এখন সারাবিশ্বে উজ্জ্বল। তিনি আরও বলেন, বরিশাল যেসব প্রকল্পের ওপর ভর করে বদলে যাচ্ছে সেগুলোও এসেছে উন্নয়নের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। এসব প্রকল্পের জন্য দীর্ঘদিন বরিশাল জেলার মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এখন সেসবের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলায় স্বস্তি ফিরে এসেছে বরিশালবাসীর মাঝে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় দক্ষিণাঞ্চলবাসীর ভাগ্য উন্নয়নে দীর্ঘদিন থেকে নিজেকে আত্মনিয়োগ করে ‘উন্নয়নের রূপকার’ খেতাব অর্জন করা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মন্ত্রী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি জনকণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতবার ক্ষমতায় এসেছেন, ততবারই দেশ এগিয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে অসংখ্য মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। এসব প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলেই দ্বিতীয় সিঙ্গাপুরের মতো ফুটে উঠবে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চল।
পদ্মা সেতু ও পায়রা বন্দরকে ঘিরে স্বপ্ন ॥ শিল্পের দিক থেকে বরিশাল অন্য বিভাগগুলোর চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বরিশালে গ্যাস নেই। উদ্যোক্তা, সস্তা শ্রম ও জমি থাকার পরেও এ জেলায় শিল্পে তেমন কোন বিনিয়োগ হয়নি। এখানে বড় শিল্প কারখানা বলতে অপসোনিন ওষুধ কারখানা, খান সন্সের সিমেন্ট কারখানা ও বিসিক শিল্পনগরীর ফরচুন সুজ নামের একটি রফতানিমুখী জুতার কারখানা রয়েছে। এর বাইরে বরিশালে উল্লেখযোগ্য বড় কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান নেই।
সচেতন বরিশালবাসীর অভিযোগ, বিভাগীয় শহর বরিশালে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়া থেকে শুরু করে উন্নয়নের দিকেও অতীতের কোন সরকার নজর দেয়নি। দেশের বিভিন্ন জেলায় রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড), নতুন করে অর্থনৈতিক অঞ্চল হলেও বরিশালে কিছুই হয়নি। এমনকি বরিশালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) শিল্পনগরীটিও রয়েছে অবহেলিত। ফলে শিল্প না থাকায় বরিশালের তরুণ ও যুবকদের কাজের খোঁজে অন্য জেলায় যেতে হয়। জেলার মানুষের মধ্যে প্রবণতাই হলো সন্তান কর্মক্ষম হলেই তাকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা কিংবা অন্য কোন শহরে কাজের খোঁজে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সূত্রমতে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের টানা মেয়াদে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে চলমান ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে অতীতের প্রবণতাকে ভুলতে চান এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। পাইপ লাইনের মাধ্যমে ভোলার গ্যাস বরিশালে আনার পাশাপাশি পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে এবং পায়রা বন্দর পুরোপুরি চালু হওয়ার পর বরিশালে শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার আশা করছেন জেলার ব্যবসায়ীরা।
বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, পায়রা বন্দর পুরোপুরি চালু হলে এ অঞ্চলে পণ্যের কাঁচামাল পরিবহন সহজ হবে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে বরিশালে পণ্য তৈরি করে তা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পাঠানো সহজ হবে। এতে বরিশালে বিনিয়োগ বাড়বে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অর্থনৈতিক শুমারির বরাত দিয়ে তিনি (জেলা প্রশাসক) বলেন, বরিশাল বিভাগে ৪৫ হাজার ৭৩৫টি উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক ইউনিট রয়েছে। যা সিলেট ছাড়া বাকি বিভাগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। তবে সিলেট বিভাগে গ্যাস থাকায় সেখানে অনেক বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান হয়েছে। সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) বরিশাল জেলা কার্যালয়ের তথ্যের বরাত দিয়ে জেলা প্রশাসক আরও বলেন, জেলায় বড় ও মাঝারি শিল্প রয়েছে ১৫টি। ক্ষুদ্র শিল্প আছে ১ হাজার ৯৫৫টি। কুটির শিল্প রয়েছে ৯ হাজার ৭১৯টি। তিনি আরও বলেন, বরিশালে যে রফতানিমুখী শিল্প কারখানা চালানো যায়, তার প্রমাণ করেছে ফরচুন সুজ। বরিশালের বিসিক শিল্প নগরীতে প্রতিষ্ঠিত এই কারখানায় প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাদের তৈরি জুতা রফতানি করা হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এ কারখানার কাঁচামাল সবই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়। আবার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই জুতা ইউরোপে যায়। পায়রা বন্দর পুরোপুরি চালু হলে তাদের কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রফতানিতে সময় কম লাগবে।
পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস আনার দাবি ॥ বরিশালের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বিজয় কৃষ্ণ দে জনকণ্ঠকে বলেন, বরিশালে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পূর্বের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবিষ্যতে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে যত অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হবে তার কেন্দ্র হবে বিভাগীয় শহর বরিশালে। এজন্য গ্যাসের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বরিশালে ১০০ জনেরও বেশি ব্যবসায়ী আছেন যারা ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় শত কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছেন। এখানে গ্যাস আসলে তারাই বরিশালে বিনিয়োগ করবেন। তিনি আরও বলেন, বরিশালে গ্যাস সরবরাহের উৎস ভোলা। কারণ বরিশাল শহর থেকে ভোলার দূরত্ব মাত্র ৩০ কিলোমিটার। ভোলায় প্রচুর গ্যাস পাওয়া গেছে। পাইপ লাইনের মাধ্যমে ভোলা থেকে বরিশালে গ্যাস আনা হলেই এ অঞ্চলে প্রচুর বিনিয়োগ হবে।
সচেতন বরিশালবাসী মনে করছেন, ভোলায় বিদ্যুত উৎপাদন করে তা অন্যান্য জেলায় দেয়া গেলে পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাসও আনা সম্ভব হবে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসী।