মার্চ মাসের শুরুর দিকে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে অনেকের মতো তৈরী পোশাক শিল্পখাতের বেশিরভাগ কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে খোলার পর স্বাভাবিক উৎপাদন কাজ শুরু করতে গিয়ে কারখানাতে দেখা দেয় নানামুখী সংকট। শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়া বা তাদের বাবস্থান, খাওয়ার সংস্থান করা, স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় কর্তৃপক্ষ তেমন একটা নজর দিতে পারেনি। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও হয়েছে। কারখানা খোলার পর হাজার হাজার কর্মীকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় থাকা-খাওয়া, চিকিৎসাসহ সার্বক্ষণিক তদারকি করছে কোন কোন প্রতিষ্ঠান।
গাজীপুরের বোর্ড বাজারে অবস্থিত হান্নান গ্রুপের পাঁচটি ইউনিটে ১২ হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করছেন। করোনার প্রকোপ শুরু হলে প্রতিষ্ঠানটির সকল কর্মীকে ছুটি দেওয়া হয়। লকডাউন শিথিল করার পর ২৭ এপ্রিল গ্রুপের সকল প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়। প্রথমে উৎপাদনের কাজ নয়, কর্মীদের মধ্যে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন কর্মকর্তারা। কারখানার ডাম্পিং এরিয়াতে (যেখানে তৈরী পণ্য রাখা হয়) ডাইনিং হলের চেয়ার টেবিল এনে কাজের ব্যবস্থা করা হয়।
কারখানা থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে একটি ভবন ভাড়া করা হয়। সেখানে বিছানাপত্রসহ সকল ধরণের বাসস্থান ও খাওয়ার সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। কোম্পানির চেয়ারম্যান এবিএম সামছুদ্দিন জানান, কারখানা খোলার প্রথম দিন থেকে কর্মীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা এবং আনুষঙ্গিক স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা শুরু হয়। তাপমাত্রা বেশি হলে ওই কর্মীকে কিছু ঔষুধসহ দুই দিনের ছুটিতে থাকতে বলা হয়। দুই দিনে তার তাপমাত্রা না কমলে তাকে কোম্পানির নির্দিষ্ট কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠানো হয়। এভাবে ১৩ শত ৫৭ জন কর্মীর জন্য মোট ৯টি সেন্টার খুলতে হয়েছে।
কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলোতে প্রতিদিন ৯টি সেন্টারে রান্না করা খাবার এবং পানি সরবরাহ করতে হয়েছে। সবাই যাতে পর্যাপ্ত গরম পানি খেতে পারে এবং গড়গড়া করার কাজে ব্যবহার করতে পারে সে জন্য ১৪ শত ফ্লাক্স দেয়া হয়েছে। আদা, লেবু, এলাচি, দারুচিনি সরবরাহ করা হয়েছে প্রত্যেকটি সেন্টারে। প্রতিদিন কোম্পানির ৬ জন ডাক্তার এবং কয়েকজন নার্স রোগীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যাদের উপসর্গ কম আছে তাদেরকে আলাদা করে দেয়া হবে। করোনার সবগুলো লক্ষণ আছে এমন রোগীদের পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। মোট ৬ শত ৭০ জনের টেস্ট করে ১৪৩ জনের করোনা ফল পজেটিভ আসে। ডাক্তাররা কারখানা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন যে, কোয়ারেন্টাইনে থাকা কর্মীদের বিভিন্ন ধরণের ভেষজ খাওয়ানোর ফলে তাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়েছে।
কোম্পানির কর্মকর্তারা বলেন, কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলো চালাতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিলো। বিশেষ করে স্থানীয় লোকজনের বিরোধীতার কারণে আমরা কারখানার কাছাকাছি সেন্টার ভাড়া নিতে পারিনি। এ ছাড়া সেন্টারগুলোতে বিভিন্ন ধরণের জিনিসপত্র পাঠাতে কর্মকর্তাদের বেগ পেতে হয়েছে। এতগুলো কর্মী যাতে একসাথে কারখানায় প্রবেশ করতে না হয় সেজন্য পুরুষ এবং নারীদের আলাদা সময়ে (আধাঘন্টা আগে ও পরে) প্রবেশ করতে দেয়া হয়েছে। ছুটির সময়ও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। প্রতিদিন সকালে কর্মীরা যখন প্রবেশ করে তখন সবার শরীরের তাপমাত্রা নেয়া ও স্যানিটাইজ করা হয়। এ ছাড়া দুপুরে এবং বিকেলে সবার আরো দুই দফা তাপমাত্রা নেয়া হয়। কারও শরীরের তাপমাত্রা বেশি হলে তাকে দুদিনের ছুটি দিয়ে পরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলে কাজে যোগদান করতে দেয়া হয়। করোনা থেকে সুস্থ রাখার জন্য কারখানায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিপুল হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরী করা হয়েছে।
১৩’শ ৫৭ জন কর্মী কোয়ারেন্টাইনে থাকলেও তারা একদিনের বেতন থেকেও বঞ্চিত হয়নি বলে জানিয়েছেন কোম্পানির নির্বাহীরা। এমনকি তাদেরকে হাজিরা বোনাসসহ পুরো বোনাস দেয়া হয়েছে। অথচ অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের ৬০ শতাংশ বেতন দিয়েছে।
কোম্পানির কর্মকর্তারা বলেন, অসুস্থ কর্মীদের যত্ন নেয়ার কারণে অন্য কর্মীদের মাঝে কাজের স্পৃহা বেড়েছে। শরীরের তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে তাদেরকে আলাদা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে খাওয়া দাওয়াসহ সব ধরণের ঔষধ দেয়া হয়েছে। করোনা ফল নেগেটিভ আসলে কাজে যোগদান করেছে। এর মধ্যে সকল বেতনভাতাও পেয়েছে।
সুপারভাইজার এমদাদুল ইসলাম জানান, করোনা পজিটিভ হবার পর আলাদা ছিলাম। কাজে ফেরার পর কারখানার পরিবেশ নিয়ে আমরা বেশ সন্তুষ্ট। কোম্পানির পক্ষ থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক এবং অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছে। কোম্পানির নিয়মিত নার্স শিখা জানান, প্রথম প্রথম ভয় পেয়েছিলাম।
উল্লেখ্য, হান্নান গ্রুপ মূলত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নামকরা ক্রেতাদের কাছে পোশাক বিক্রি করে থাকেন। কোম্পানির বার্ষিক টার্নওভার ৮০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।