ওষুধশিল্পের বিস্ময়কর বিকাশ

admin
মার্চ ২৯, ২০২১ ১:০২ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ক্যান্সার, হার্টের অসুখসহ অনেক উচ্চমূল্যের ওষুধ তৈরি হচ্ছে দেশে

স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে বাংলাদেশে ওষুধশিল্পের বিস্ময়কর বিকাশ ঘটেছে। চিকিৎসা খাতে অব্যবস্থাপনা থাকলেও বেসরকারি খাতের উদ্যোগে ওষুধ উৎপাদন ও রপ্তানিতে বাংলাদেশ অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে যেখানে বিদেশি ওষুধের ওপর নির্ভরতা ছিল প্রায় শতভাগ, সেখানে ৫০ বছর পর বিশ্বের ১৪৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদনে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ এখন এক নির্ভরতার নাম। শুধু সাধারণ নয়, বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো এখন ভ্যাকসিন, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ওষুধ, ইনসুলিনসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করছে। ইতিমধ্যে দেশের অন্তত ১৪টি কোম্পানি বিভিন্ন দেশে নিবন্ধন পেয়েছে। এর মাধ্যমে সেসব দেশে আরও বিপুল পরিমাণ ওষুধ রপ্তানির পথ প্রশস্ত হয়েছে। দেশের প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধের বাজারের ৯৮ শতাংশই স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোর দখলে। ১৭ কোটি মানুষের এই দেশের প্রায় পুরো চাহিদা মিটিয়ে দেড় হাজার কোটি টাকার ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে প্রতি বছর। উদ্যোক্তারা বলছেন, অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী মূল্য ও ওষুধের গুণগত মানের কারণে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি ওষুধের চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে বাংলাদেশের ওষুধের বাজার। এ অবস্থায় প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বের ওষুধ-বাণিজ্যের অন্তত ৫ শতাংশ দখল করা সম্ভব বলে মনে করছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। গত মাসে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। এই সুপারিশ অনুযায়ী, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে চূড়ান্ত উন্নীত হবে। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে বর্তমানে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে হয় না। গরিব দেশে ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে এ সুবিধা দিচ্ছে অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) উৎপাদক দেশগুলো। আর এ সুবিধা পাওয়ার কারণে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধ খাতে বর্তমানের অর্জনের পেছনে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশের ওষুধের চাহিদা দিন দিন বাড়ার মূল কারণ বিশ্ব বাজারের তুলনায় দাম অনেক কম। ভারতীয় একটি দৈনিকের প্রতিবেদন বলছে, উন্নত বিশ্বে যে ওষুধের দাম গড়ে ৪২৫ ডলার, বাংলাদেশে এর দাম মাত্র ৩২ ডলার। মানও খারাপ নয়। তবে ওষুধের বাজার বিকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওষুধের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়াটা সহজ ছিল না। ইউরোপ-আমেরিকায় ওষুধের মতো স্পর্শকাতর পণ্য বাজারে যায় কঠিনভাবে মান যাচাইয়ের পর। তাদের মান যাচাইয়ের প্রক্রিয়ার ওপর সবাই আস্থাশীল। সেই মান যাচাইয়ের পরীক্ষায় পাস করেই বাংলাদেশের ওষুধ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। আমেরিকায় ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এফডিএর ছাড়পত্র পাওয়া দুরূহ, সময়সাপেক্ষ। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও ওষুধশিল্পের সুনাম বিশ্বজুড়ে। গুণগত মান ও কার্যকারিতার কারণে বাংলাদেশের ওষুধ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ববাজারে। অনুন্নত বিশ্বের ৪৮ দেশের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশের ওষুধ। দেশের ২৫৭টি কোম্পানির কারখানায় বছরে ২৪ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। এ শিল্পে প্রায় ২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। এসব তথ্য দিয়ে ওষুধশিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, তারা এ অগ্রযাত্রা আরও বেগবান করতে চান। ক্যান্সারের ওষুধের সঙ্গে বাংলাদেশ তৈরি করছে হেপাটাইটিস সির ওষুধ। ৮৪ ডোজের চিকিৎসায় ১ ডোজের খরচ ১ হাজার ডলার। পুরো কোর্সে খরচ ৮৪ হাজার ডলার। বাংলাদেশে তৈরি এর ১ ডোজের দাম পড়ে মাত্র ৮০০ টাকা। দেশের ৪৬ কোম্পানির ৩০০ ধরনের ওষুধপণ্য বিশ্ববাজারে রপ্তানি হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, জাতীয় অর্থনীতিতে ওষুধশিল্পের অবদান বাড়ছে। জিডিপিতে ওষুধ খাতের অবদান ছিল প্রায় ৩ শতাংশ। বর্তমানে ২৫৭টি অনুমোদিত কোম্পানির মধ্যে উৎপাদনে রয়েছে ১৫০টি। ওষুধের বৈশ্বিক বাজারের হিসাবে দেখা যায়, ২০১৮ সালের শুরুতে বিশ্বব্যাপী ওষুধের বাজার ছিল ১ হাজার ২০৫ বিলিয়ন ডলারের, যেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে এটা ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ওষুধশিল্প সমিতির তথ্যানুযায়ী, গত দুই বছরে ১ হাজার ২০০ ধরনের ওষুধ রপ্তানির অনুমোদন পাওয়া গেছে। রপ্তানিতে শীর্ষ সাত দেশ হচ্ছে- মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, কেনিয়া ও স্লোভেনিয়া। মোট ওষুধ রপ্তানির ৬০ শতাংশ যাচ্ছে এসব দেশে। আর বাকি ৪০ শতাংশ অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়। রপ্তানির শীর্ষে রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইনসেপ্টা ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। বাংলাদেশের তৈরি ওষুধ এশিয়া মহাদেশের ৪১টি দেশে, দক্ষিণ আমেরিকার ২৩টি দেশে, আফ্রিকা মহাদেশের ৩৭টি, উত্তর আমেরিকার ৪টি দেশে, ইউরোপের ৩২টি ও অস্ট্রেলিয়ার ৫টি দেশে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে। ওষুধ রপ্তানির তালিকায় রয়েছে বেক্সিমকো, স্কয়ার, ইনসেপ্টা, একমি ল্যাবরেটরিজ, এরিস্টোফার্মা, রেনেটা লিমিটেড, এসকেএফ ফার্মা, এসিআই লিমিটেড, পপুলার ফার্মা, পপুলার ইনফিউশন, বায়ো ফার্মা, অপসোনিন, গ্লোব ফার্মা, বিকন ফার্মা, ড্রাগস ইন্টারন্যাশনাল, হেলথকেয়ার ফার্মা, ওরিয়ন ফার্মা, জেসন, নাভানা, জেনারেল, ডেলটা, গ্লাস্কো, ইবনে সিনা, রেডিয়ান্ট, নভো হেলথকেয়ার ফার্মা, নিপ্রো জেএমআই, ইডিসিএল লিমিটেড, অ্যামিকো ল্যাবরেটরিজ, গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস, টেকনো ড্রাগস, জিসকা ফার্মাসিউটিক্যালস, রেডিয়েন্ট ফার্মাসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি। জানা গেছে, বাংলাদেশের তৈরি ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, ইনজেকশন ও ইনহেলারসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। তবে বিদেশে ওষুধগুলো জেনেরিক নামে ব্যবহার হচ্ছে। তবে জেনেরিক নামের পাশাপাশি ব্র্যান্ডেড নামও থাকছে। তবে ক্যান্সার, মস্তিষ্কজনিত সমস্যা, হƒদরোগ, ডায়াবেটিস ও ভ্যাকসিনসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির কিছু ওষুধ আমদানি করতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশের কয়েকটি কোম্পানি ভ্যাকসিন ও ক্যান্সারের ওষুধ তৈরিতে এগিয়ে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ওষুধের মেধাস্বত্বে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ছাড়ের সুযোগ রয়েছে। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের কারণে সেই সময়সীমার সাত বছর আগেই ২০২৬ সালে মেধাস্বত্বের সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। তখন ওষুধের কাঁচামালের জন্য নির্দিষ্ট হারে অর্থ দিতে হবে। বর্তমানে ওষুধশিল্পের কাঁচামালের ৯৭ শতাংশই উন্মুক্ত প্যাটেন্ট সুবিধায় আমদানি করছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালে এই সুবিধা শেষ হলে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প পিছিয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী ব্যবসায় প্রভাব নিয়ে সম্প্রতি সিপিডির আলোচনা সভায় অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হওয়ার পর আমাদের ওষুধশিল্প বিপাকে পড়বে। বেশি দামে কাঁচামাল কিনে রপ্তানি বাজারে টিকতে পারবে না। কারণ হিসেবে এপিআই শিল্পপার্ক এখনো প্রস্তুত নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে একই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে উদ্ধৃত করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, আমাদের এপিআই পার্ক প্রায় প্রস্তুত। এখন কোম্পানিগুলো চাইলেই কাজ শুরু করে উৎপাদনে যেতে পারবে। এদিকে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ওষুধের মেধাস্বত্বে ছাড়ের সুবিধা মাথায় রেখে এপিআই শিল্পপার্কের বিনিয়োগে আগামী ২০৩২ সাল পর্যন্ত আয়কর, ভ্যাটসহ সব ধরনের ট্যাক্স ছাড় দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মুন্সীগঞ্জের ওষুধশিল্প পার্কের উদ্যোক্তাদের আগামী ১০ বছর পর্যন্ত কোনো ভ্যাট ও ট্যাক্স দিতে হবে না। এটি একটি বড় নীতি সহায়তা বলে মনে করছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। ইতিমধ্যে ২৭টি কোম্পানি সেখানে কারখানা স্থাপনের জন্য প্লট বরাদ্দ নিয়েছে। এর মধ্যে একমি, হেলথকেয়ারসহ কয়েকটি কোম্পানি কারখানা নির্মাণের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যে এসব কারখানায় উৎপাদন শুরু করা যাবে বলে জানিয়েছে কোম্পানিগুলো। যারা ২০২২ সালের মধ্যেই উৎপাদনে যেতে পারবেন তারা টানা ১০ বছরই ভ্যাট ও ট্যাক্স রেয়াতের সুবিধা পাবেন।
মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া ওষুধশিল্প পার্কের নির্মাণকাজ বর্তমানে শেষের পথে। ২০০ একর জমিতে নির্মিত শিল্পপার্কটিতে এরই মধ্যে মাটি ভরাট, অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণ, ড্রেনের অবকাঠামো, বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিশন লাইন, বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন, বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন, পানি সরবরাহের প্রধান ও সাব লাইন নির্মাণ, প্লট তৈরিসহ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শেষ হয়েছে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইপিটি) নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে। শতভাগ কাঁচামাল দেশে উৎপাদিত হলে ওষুধের মূল্য যেমন কমে আসবে, পাশাপাশি ওষুধ ও কাঁচামাল রপ্তানির পরিমাণও বাড়বে। ওষুধশিল্প পার্কের প্রকল্প পরিচালক শহিদুল ইসলাম জানান, আগামী জুনের মধ্যে ওষুধশিল্প পার্কের সব অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ হয়ে যাবে। উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ওষুধশিল্প পার্কের পুরো অবকাঠামো। এখন কোম্পানিগুলো নিজেদের প্রস্তুতি যতটা দ্রুত করতে পারে তত দ্রুই শিল্পপার্ক উৎপাদনমুখর হয়ে উঠবে বলে আশা করছি। জানা গেছে, সম্ভাবনাময় ওষুধশিল্পের বিকাশে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে ধরা হচ্ছে- ‘কাঁচামাল উৎপাদন’। আর এ কারণে ওষুধশিল্পের অপার সম্ভাবনার সুযোগকে প্রত্যাশিতভাবে কাজে লাগাতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে সে প্রতিবন্ধকতা কেটে যাবে এপিআই শিল্পপার্কের উৎপাদন শুরু হলে। এই শিল্পপার্কে কাঁচামাল উৎপাদনের সব ধরনের সুবিধা থাকবে। চলতি বছর থেকেই ওষুধ কোম্পানিগুলো সেখানে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনের কারখানা স্থাপন শুরু করবে। ফলে ওষুধের কাঁচামাল আমদানি খরচ শতকরা ৭০ ভাগ কমে আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের বিকাশ খুবই আশাব্যঞ্জক। বছর কয়েক আগেও জীবন রক্ষাকারী ৫০ শতাংশেরও বেশি ওষুধ আমদানি করতে হতো। এখন সেটা অনেক কমে এসেছে। দেশেই কাঁচামাল উৎপাদন শুরু হলে ওষুধ উৎপাদন খরচ অনেক কমে আসবে। ওষুধশিল্পের বিকাশে এটি অনেক সহায়ক হবে। বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির তথ্যানুযায়ী, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ২৬৯টি ছোট-বড় ওষুধ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৪টি ওষুধ কারখানা সক্রিয় রয়েছে। এসব কোম্পানি সম্মিলিতভাবে প্রায় ৫ হাজার ব্র্যান্ডের ৮ হাজারের বেশি ওষুধ উৎপাদন করছে। অন্যদিকে ৪০টি কোম্পানি ১৮২টি ব্র্যান্ডের সহস্রাধিক রকমের ওষুধ রপ্তানি করে। ওষুধশিল্প পার্কের প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ শহিদুল ইসলাম বলেন, চলতি বছরের জুনের মধ্যেই আমাদের সব অবকাঠামোর কাজ শেষ হবে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইপিটি) একটি অংশের কাজও এই সময়ের মধ্যে শেষ হবে। বরাদ্দ নেওয়া কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে জুনের পরই শিল্পপার্কে কাঁচামাল উৎপাদন শুরু করতে পারবে। তিনি বলেন, হেলথকেয়ার এবং এসিআই লিমিটেডের কারখানার কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। তবে কোম্পানিগুলোর নিজস্ব অবকাঠামো তৈরি, মেশিনারিজ আমদানিসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করতে আরও এক বছর লেগে যেতে পারে। এদিকে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী ২০২২ সালের জুনের মধ্যেই উৎপাদন শুরু করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। একমি ল্যাবরেটরিজের কোম্পানি সেক্রেটারি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের ভবন নির্মাণের কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে আরও কিছু দিন লাগবে। তবে ২০২২ সালের জুনে উৎপাদন শুরু করতে পারব।
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় এখন থেকে পাঁচ বছর আগেই (২৪ আগস্ট, ২০১৬) সাংবাদিক অমিত বসু বাংলাদেশের ওষুধশিল্প নিয়ে এক অনবদ্য প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ‘এখন দুনিয়া দাপাচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প’ শিরোনামের প্রতিবেদনটির কিছু অংশ : ‘কী ছিল আর কী হলো। মাঝের চার দশকে আমূল পরিবর্তন। একাত্তরে স্বাধীন হওয়ার পর মুমূর্ষু বাংলাদেশ। অন্নের সঙ্গে ওষুধের সংকট। বাঁচতে হলে দুটোই দরকার। রোগশয্যার রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে ডাক্তার জানিয়ে দিচ্ছেন, এসব ওষুধ আপনাদের জোগাড় করতে হবে। ওষুধ তো আকাশের মেঘ নয় যে বৃষ্টি হয়ে টুপটাপ ঝরবে। অনেক কষ্টে ২০ শতাংশ ওষুধ দেশে তৈরি। বাকি ৮০ শতাংশ আসবে কোত্থেকে। পাকিস্তান দিতে পারত। তারা দেওয়া বন্ধ করেছে। প্রকারান্তরে বলতে চাইছে, বোঝ এবার স্বাধীন হওয়ার জ্বালা। ইউরোপ, আমেরিকার বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিও ওষুধ দিতে নারাজ। তাদের সাফ কথা, ডলার দাও, ওষুধ নাও। সদ্য স্বাধীন দেশে ডলারের রিজার্ভ তখন শূন্য। দুঃসময়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় পূর্ব ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরি। সেখানকার ওষুধ সংস্থা ইগিস, গেইডেন, রিখটার কাইরন, মেডিম্পেস বাংলাদেশে ওষুধ সরবরাহে রাজি হয়। তারা জানিয়ে দেয়, বার্টার সিস্টেমে বা পণ্যের বিনিময়ে ওষুধ দেবে। এ তো হাতে চাঁদ পাওয়া। হাঙ্গেরিতে যেতে লাগল বাংলাদেশের পাট আর অন্যান্য কাঁচা পণ্য। পরিবর্তে এলো ওষুধ।
অন্যের করুণায় বাঁচাটাও তো সম্মানের নয়। ধীরে ধীরে ওষুধ উৎপাদন শুরু বাংলাদেশে। বিদেশি সংস্থার মাথায় হাত। বাংলাদেশের বাজার হারালে যে বিরাট ক্ষতি। ১৯৮২-তে অর্ডিন্যান্স জারি করে বিদেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ। কুঁড়ি থেকে ফুল হওয়ার মতো পাপড়ি মেলল বাংলাদেশের ওষুধশিল্প। এই মুহূর্তে বিশ্বের অনুন্নত ৪৮ দেশের মধ্যে ওষুধ উৎপাদনে শীর্ষে বাংলাদেশ। ২৫৭ কোম্পানির ২৪ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ। বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। রপ্তানি বাড়ছে দ্রুত। কর্মসংস্থান দু’লাখের। উল্টো দিকে এখন পাকিস্তানের ওষুধশিল্পে ভাটার টান। অভাব মেটাতে বাংলাদেশের কাছে ওষুধ চাওয়ারও মুখ নেই। ……..আপাতত বাংলাদেশের ওষুধ যাচ্ছে ১৪৭ দেশে। চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ছে। জীবনদায়ী ওষুধ দিয়ে বিশ্বকে বাঁচাচ্ছে বাংলাদেশ। সেই ওষুধেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রাণের জোয়ার।’ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ওষুধশিল্পে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার পেছনে ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি বড় ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়া সরকার ওষুধশিল্পের ওপর নানা ধরনের সুবিধা প্রদানের কারণে এটি বিশ্বের কাছে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট। যাদের বিরাট একটা অংশ ওষুধশিল্পে কাজ করছেন। বিশ্বের অনেক দেশেই গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নেই। বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম সফিউজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের ওষুধ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিন দিন রপ্তানির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে কয়েকটি দেশীয় কোম্পানির সঙ্গে ওষুধ তৈরি করছে। ভবিষ্যতে ওষুধশিল্প রপ্তানির শীর্ষে থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।