১৯৭১ সালে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তানী শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল বাঙালী জাতি। অর্জন স্বাধীন একটি ‘দেশ’। এরপর মুক্ত, যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বদেশে বৈষম্যহীন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই দেশের মানুষ যাতে আর কোন দিন অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার না হয়, গ্রামপ্রধান-কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের মেহনতি মানুষ যাতে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে সে জন্য তিনি সংবিধান রচনা করান চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও তিনি প্রাধান্য দেন সুষম একটি অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার ওপর। দারিদ্র্য জয় করে দীর্ঘ ৪৯ বছরে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল। রফতানি, রিজার্ভ, জিডিপি থেকে শুরু করে দেশের বাজেটের আকার, সরকারী-বেসরকারী বিনিয়োগ, রাজস্ব আয়, রেমিটেন্স আহরণ, দারিদ্র্য নিরসন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো তৈরি ও উন্নয়ন, বিদ্যুত উৎপাদন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসেছে সফলতা। নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করা হচ্ছে সহজ নক্সায় বিশ্বের দীর্ঘতম দৃষ্টিনন্দন সেতু। ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলাদেশকে তুলে ধরছে বিশ্বের দরবারে।
জানা যায়, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি মৃত্যুর দুয়ার থেকে দেশে ফিরে এসে ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনৈতিক বক্তৃতায় কিংবা সংসদে দেয়া বক্তৃতার সবটা জুড়েই ছিল বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা। যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সোনার বাংলা শ্মশান হয়েছিল পাকিস্তানী আমলে, তিনি সেই শ্মশান বাংলাকে আবার সোনার বাংলায় রূপান্তরের স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নামেন। স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ যাতে আর কোন দিন অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার না হয়, গ্রামপ্রধান-কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের মেহনতি মানুষ যাতে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে সে জন্য তিনি সংবিধান রচনা করান চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে। সংবিধানের চার মূলনীতিই প্রমাণ করে তিনি ভেদাভেদ-বৈষম্যহীন একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে কতটা আন্তরিক ছিলেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও তিনি প্রাধান্য দেন সুষম একটি অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার ওপর। প্রথম এ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলোর দিকে নজর দিলেই এই সাক্ষ্য মেলে যে তিনি একটি সুষম, দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই একটি অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তুলতে কতটা আন্তরিক ছিলেন। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলো ছিল- (১) দারিদ্র্য দূরীকরণ। বেকারদের কর্মের সুযোগ সৃষ্টি, কম মজুরিতে নিযুক্তদের মজুরি বৃদ্ধি, জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সমতাভিত্তিক আইন ব্যবস্থা। (২) পুনর্নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখা। কৃষি ও শিল্প খাতসহ অর্থনীতির প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে উৎপাদন সামর্থ্য ও সময়োপযোগী মাত্রায় বৃদ্ধি করা। (৩) বার্ষিক জিডিপি অন্তত ৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধি সার্বক্ষণিক চাকরির সংখ্যা ৪১ হাজারে উন্নীতকরণ, অসংগঠিত খাতের শ্রমশক্তিকে সংগঠিত করা, উন্নয়নমুখী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা। (৪) খাদ্য, বস্ত্র, ভোজ্যতেল, কেরোসিন এবং চিনির মতো অপরিহার্য দ্রব্যসামগ্রীর প্রাপ্তি ও স্বল্পমূল্য নিশ্চিত করা। (৫) দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি (যা বিগত বছর থেকে বাংলাদেশের একটি বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে) রোধ করা এবং অপরিহার্য দ্রব্যসামগ্রীর ক্ষেত্রে মূল্য কমানো। (৬) মাথাপিছু বার্ষিক আয় অন্তত ২.৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা। এমনভাবে গতি-নির্ধারণ করা, যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সম্পদের তুলনায় অধিক হারে বার্ষিক আয় ভোগ করতে পারে। আয় এবং সম্পদের ওপর সিলিং ধার্য করে এবং আদায়কৃত রাজস্বের পুনর্বণ্টন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটা করা হবে। (৭) সমাজতন্ত্রে রূপান্তর প্রচেষ্টায় অর্জিত সাফল্যকে সমন্বিত করা, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে সমাজতন্ত্রমুখী করা এবং এতদুদ্দেশ্যে সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধন করা। (৮) দেশীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির মাধ্যমে পরনির্ভরতা কমিয়ে আনা। রফতানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণ এবং দক্ষতার সঙ্গে আমদানি বিকল্প খুঁজে বের করার মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিময়ের ভারসাম্যহীনতা রোধ করা। (৯) খাদ্য-শস্য উৎপাদনে আত্মনির্ভরতা অর্জন, কৃষি ক্ষেত্রে সুযোগ সম্প্রসারণ এবং শহরমুখী শ্রমিক ¯্রােত ঠেকানোর উদ্দেশ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরিভিত্তিক কৃষি-ভিত্তি গড়ে তোলা। (১০) জনসংখ্যা পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের একটি উচ্চাভিলাষী গ্রাউন্ডওয়ার্ক সম্পাদন করা; জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতির অঙ্গীকার ও সামাজিক সচেতনতা নিশ্চিত করা; জনসংখ্যা পরিকল্পনার জন্য একটি যথোপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো সৃষ্টি; অনবরত ও নিবিড় মূল্যায়ন ও গবেষণার ব্যবস্থাসম্পন্ন পরিবার-পরিকল্পনার বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বাৎসরিক জনবৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ থেকে ২.৮ শতাংশে কমিয়ে আনা। (১১) শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ গৃহায়ণ এবং জল সরবরাহ ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে চিরাচরিতভাবে অবহেলিত সামাজিক ও মানবসম্পদের উন্নয়ন সাধন। (১২) সমগ্র দেশে, ভৌগোলিক অঞ্চল নির্বিশেষে সমহারে আয় ও কর্মের সুযোগ সম্প্রসারিত করা, অর্থনৈতিক সুযোগ সম্প্রসারিত অঞ্চলে শ্রমিকের গমনাগমন উৎসাহিত করা।
জানা যায়, স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় চরম দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ মারা যায়। আর স্বাধীনতার পর গত চার দশকে বিদেশী রাষ্ট্রের শোষণমুক্ত বাংলাদেশ বেশ পুষ্ট হয়েছে। অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বহু পথ এগিয়েছে। পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প কোন প্রকার বৈদেশিক সহায়তা ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এক অনুষ্ঠানে এসে বাংলাদেশের গৌরবময় অর্জনের কথা শুনিয়ে যান নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অগ্রগতির ওপর আলোকপাত করে তিনি বলেন, যারা এক সময় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছিল তারা আজ এ দেশকে ‘উন্নয়নের মডেল’ মনে করছে। স্বাধীনতার পর এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির এ অর্জনকে ‘রোল মডেল’ মনে করছে বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশ। অনেক ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছে। দারিদ্র্য বিমোচন, নারী শিক্ষা, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমানো, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার মতো বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি নজর কেড়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের।
মূলত ১৯৭১ সালে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তানী শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল বাঙালী জাতি। স্বাধীনতার চার দশক পর সে স্বপ্ন অর্জনের পথে অনেকটাই এগিয়েছে দেশ। আর এ স্বপ্ন পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে রফতানি খাত। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের রফতানি খাত কাঁচা চামড়া ও পাট নির্ভর হলেও সময়ের আবর্তনে সে তালিকায় যুক্ত হয়েছে তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, চামড়াজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণসহ হালকা ও মাঝারি শিল্পের নানা পণ্য। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের রফতানি আয় গত ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৫০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই ছিল বিদেশী সহায়তানির্ভর। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে সরকার। অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ মনে করেন, ‘মাাথাপিছু কম জমি নিয়ে আর কোন দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে এমন ইতিহাস করেনি, যেভাবে করতে পেরেছে বাংলাদেশ। এজন্য আমাদের বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে ক্রমাগতভাবে বেশি করে সংযুক্ত হতে হবে। যে শিল্প পণ্যগুলো বহুমুখী করে রফতানি করব, সেগুলোর কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমাদেরকে আমদানি করতে হবে, এটাই এখন চ্যালেঞ্জ।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সবটুকু জায়গাজুড়ে ছিল শুকনো মুখ, হাড় জিরজিরে, ঘোলা চোখে পথ দেখে চলা মানুষেরা- বাংলার এ গণমানুষই বঙ্গবন্ধুর মানসপটে একটা স্বপ্ন খোদাই করে দিয়েছিল। ঘিরে দিয়েছিল তার স্বপ্নের ফসলভূমি। স্বপ্ন তিনি পূরণ করতে পারেননি। সেই সময় তাকে দেয়া হয়নি। আবহমান বাংলার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে একটা টেকসই অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তোলার যে বাস্তবানুগ পরিকল্পনা তিনি গ্রহণ করেছিলেন সেই ভিত্তির ওপরই আজকের বাংলাদেশে সমৃদ্ধ অর্থনীতির ভিত্তিভূমি তৈরি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমৃদ্ধ অর্থনীতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করতে সারাবিশ^কে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪৯ বছরে আমাদের অর্জন অনেক। দেশের রফতানি খাত বিশ্ব বাজারে এখন একটি উজ্জ্বল নাম। এছাড়া দেশের অর্থনীতিকে আরও অগ্রসর করতে সরকার বড় বড় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে দেশের ব্যবসায়ীরা অনেক পরিকল্পনা করছেন, যা দেশের অর্থনীতিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে। এখন মানুষ আত্মনির্ভরশীল হচ্ছে। সরকারের নীতিগত সহায়তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পেলে দেশ আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি ॥ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুরু হয়েছিল ঋণাত্মক দিয়ে। ওই সময় দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাইনাস ১৩.৯৭ শতাংশ। এর পর থেকেই উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায় প্রবৃদ্ধি। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্যও ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। কিন্তু মহামারীর মধ্যে দুই মাসের লকডাউন আর বিশ্ব বাজারের স্থবিরতায় তা বড় ধাক্কা খায়। গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সরকারী হিসেবে ৫.২৪ শতাংশে নেমে আসে। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৮.১৫ শতাংশে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় ৭.৮৬ শতাংশ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭.৫০ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৫০ শতাংশ।
মাথাপিছু আয় ॥ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯০৯ মার্কিন ডলার। আর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল মাত্র ১২৯ মার্কিন ডলার। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় প্রায় ১৫ গুণ বেড়েছে। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এ তিনটি সূচকের দুটিতে উত্তীর্ণ হলে কোন দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশ তিনটি সূচকেই যোগ্য বিবেচিত হয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এর যে কোন দুটি সূচকে জাতিসংঘের মানদ- ধরে রাখতে পারলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হবে। মানবসম্পদ সূচকে পাঁচটি বিষয়ের পরিসংখ্যান বিবেচনায় নেয় জাতিসংঘ।
বাজেট ॥ স্বাধীনতার পর থেকে (১৯৭২-৭৩ থেকে ২০১৯-২০) দেশে জাতীয় বাজেটের আকার বেড়েছে ৪৩২ গুণ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে প্রথম বাজেট ঘোষণা করা হয়। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ৭৮৬ কোটি টাকার প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটের আকার বেড়ে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ॥ ১৯৭২ সালে মাত্র ২ বিলিয়ন ডলার ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ। বিদেশী মুদ্রার সঞ্চয়ন ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে এলে ভাবমূর্তি নষ্ট হবে বলে ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন আকুর আমদানি বিল বকেয়া রাখতে বাধ্য হয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯ বছরের মাথায় সেই রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এই হিসাবে গত ১৯ বছরে বাংলাদেশের রিজার্ভ বেড়েছে ৩৮ গুণ। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশী মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশকে দুই মাস পরপর পরিশোধ করতে হয় আকুর বিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বেড়েছে ৪৩ শতাংশের বেশি।
রেমিটেন্স ॥ মহামারীর কারণে রেমিটেন্স কমে যাবে বলে ধারণা করা হলেও তা ঘটেনি। মহামারীর আঁচ বিশ্বের অর্থনীতিতে লাগার পর গত এপ্রিল মাসে রেমিটেন্স কমলেও এরপর থেকে রেকর্ড পরিমাণে আবার বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-নবেম্বর পাঁচ মাসে মোট ১০ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স এসেছে। চলতি মাসের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে মোট ১১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স এসেছে দেশে। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে রেমিটেন্স বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ ছয় মাসে (২০০০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন) এসেছিল ৮ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মহামারীর এই কঠিন সময়েও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বেড়েই চলেছে। আর এ কারণেই বছর শেষ না হতেই ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বছর শেষে তা ২২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করছি।’
রফতানি ॥ করোনাভাইরাসের প্রভাবে ইউরোপ আমেরিকার মতো বড় বাজারে রফতানি আয় নিয়ে শঙ্কা বাড়লেও চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নবেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রফতানিতে আয় বেড়েছে। এ সময়ে এক হাজার ৫৯২ কোটি ৩৫ লাখ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ আয় করেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫৭৮ কোটি ডলার। এ হিসাবে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে বৃদ্ধির হার ১ শতাংশের মতো। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এই পাঁচ মাসে তৈরি পোশাক রফতানি থেকে আয় হয়েছে এক হাজার ২৮৯ কোটি ৪৫ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১.৪৮ শতাংশ কম হলেও নিট পোশাক রফতানিতে উল্লম্ফন ঘটেছে। মোট পণ্য রফতানির ৪৫ শতাংশই এসেছে নিট পোশাক রফতানি থেকে।
বিদেশী বিনিয়োগ ॥ করোনাভাইরাসের সংক্রমণে অন্যান্য খাতের মতো বিনিয়োগেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। চলতি বছর জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে নয়টি শতভাগ ও ১১টি যৌথ বিনিয়োগের জন্য মোট ২০টি নিবন্ধিত বিদেশী শিল্পে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে ৪৪টি শতভাগ বিদেশী ও যৌথ বিনিয়োগ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে দেশে বিদেশী বিনিয়োগের প্রস্তাব কমেছে ৯২ দশমিক ৬১ শতাংশ বা ১৬ হাজার ১১৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা।