স্বাধীনতার পরপরই রাজধানী ঢাকাকে সুপরিকল্পিত বাসযোগ্য আধুনিক ঢাকা গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সাল থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত মাত্র তিন বছরে নিয়েছিলেন নানা উন্নয়নমূলক জনহিতকর কাজের উদ্যোগ। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য রাজধানী গড়তে ঢাকাকে সাজাতে তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তৎকালীন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) যা বর্তমান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে নানা দিক নির্দেশনামূলক কর্ম সম্পাদনের নির্দেশনা দেন। যা বাস্তবায়ন করে ডিআইটি কর্তৃপক্ষ। বঙ্গবন্ধুর আমলের সরকার কর্তৃক (১৯৭২-৭৫) সাল পর্যন্ত রাজধানীর সার্বিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে নানা দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী তৎকালীন সম্পাদিত বিভিন্ন কর্ম ও পরিকল্পনা সম্পর্কে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি রাজউক পাঠানো চিঠিতে সকল তথ্য তুলে ধরা হয়। এর বাইরেও বেশ কিছু কাজ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। একই সঙ্গে কিছু প্রকল্পের কাজ চলমান ছিল যা পরবর্তীতে বিভিন্ন সরকারের আমলে তার বাস্তবায়ন হয়। উন্নত দেশ গড়ার জন্য দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে উন্নত বিশ্বের ন্যয় মাথা তুলে দাঁড়াতে আধুনিক ঢাকা গড়তে মাঠে নেমে যান বঙ্গবন্ধু।
রাজধানীর উন্নয়নের জন্য তৎকালীন ডিআইটি আইনের শিরোনাম পরিবর্তন ও সংশোধন করা, গৃহায়ন ও দরিদ্র লোকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাসহ শিল্পাঞ্চল এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা, রাজধানীকে পরিকল্পনামাফিক সাজাতে স্থপতি নিয়োগ দেয়া, কোথায় কি হবে তা নির্ধারণ করেছিলেন তিনি। এছাড়া দেশী বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বৃদ্ধি করতে দূতাবাস ভবন নির্মাণ করা, পুলিশ স্টেশন নির্মাণ করাসহ একটি দেশের সার্বিক উন্নতিকল্পে রাজধানীকে সাজাতে নানা রকম সূদুরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সূত্র জানায়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শুধু দেশকে স্বাধীন করেই বসে থাকেন নি। একইসঙ্গে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে নানা নির্দেশনা প্রদান করেন ও সময়মতো তা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানার মাধ্যমে নিয়মিত এসব কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করতেন।
সূত্র জানায়, গত ৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর আমলে ১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সকল কর্মকান্ডের সকল তথ্য প্রদান করতে মন্ত্রণালয়কে চিঠি প্রদান করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। চিঠিতে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর আমলের গৃহীত গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সকল কর্মকা- জানাতে বলা হয়। চিঠিতে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর আমলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রণীত বিভিন্ন আইন, বিধি বিধান ও কর্মপরিকল্পনার তথ্যাদি প্রদান করা, আইন ও বিধি বিধানের আলোকে কতগুলো প্রতিষ্ঠান বা শাখা অফিস স্থাপিত হয়, বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সৃজিত পদের সংখ্যা ও জনবল নিয়োগের তথ্য প্রদান করা, কতগুলো সরকারী ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয় ও কতগুলোর কাজ সম্পন্ন করা হয় তার তথ্য প্রদানের কথা বলা হয়। একইসঙ্গে গৃহহীন ও দরিদ্র লোকদের পুনর্বাসনের জন্য বঙ্গবন্ধুর গৃহীত কর্মসূচীগুলোর বিবরণ ও কতগুলো পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল তা প্রদান, অর্থবছর অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ কত ছিল, পরিত্যাক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ও নগর পরিকল্পনা সংক্রান্ত তথ্যাদি প্রদান করা ছাড়াও এ সংক্রান্ত অন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি প্রদান করতে থাকলে তাও বলা হয়েছে। এ চিঠির প্রেক্ষিতে রাজউককে মন্ত্রণালয় কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর আমলের সম্পাদিত ও গৃহীত সকল কর্মকা- সংগ্রহ করে তা প্রদান করতে চিঠি দেয়া হয়। এরই প্রেক্ষিতে রাজউক সকল তথ্য প্রদান করে।
মন্ত্রণালয়কে দেয়া রাজউকের দেয়া তথ্যে দেখা যায়, ক্ষমতায় আসার পরপরই বর্তমান রাজউক সাবেক ডিআইটির বেশ কিছু পরিবর্তন করেন। এর মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল এ্যাক্ট নং ২ যা দি বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন এ্যাক্ট ১৯৫২ আইনটির শিরোনাম রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে পরিবর্তিত হয়। এছাড়া ডিআইটি মেইনটেনেন্স ও ম্যানেজমেন্ট অব বিল্ডিং, শপ এ্যান্ড মার্কেট রুলস ২৭ মে ১৯৭৪ প্রবর্তন করা হয়। এছাড়া পরিকল্পিত নগর গড়তে ও নগর পরিকল্পনার উন্নয়নে ৩০ নবেম্বর ১৯৭২ সালে একজন সহকারী প্রধান স্থপতি সহকারী স্থপতি ২ জন নিয়োগ করে। এরপর ১৯৭৩ সালের ২৯ জানুয়ারি একজন আইন উপদেষ্টা ও সহকারী আইন উপদেষ্টা নিয়োগ করে।
অপরদিকে গুলশান উত্তর বাণিজ্যিক এলাকায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে পুলিশ স্টেশন ও আউটপোস্ট স্থাপন করতে ৩ বিঘা জমি প্রদান করা হয়। শিক্ষা বিস্তারের স্বার্থে বনানী বিদ্যানিকেতন এর স্কুল ভবন নির্মাণের জন্য ২৯ মে ১৯৭২ সালে ৭ বিঘা জমি প্রদান করা হয়। বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে বর্তমান রাশিয়া দূতাবাস তৎকালীন ইউএসএসআরকে ভবন নির্মাণের জন্য ১৯৭২ সালের ২৮ ডিসেম্বর দুটি প্লট বরাদ্দ প্রদান করা হয়। পরে ১৯৭৩ সালে ৩০ আগস্ট গুলশান বাণিজ্যিক এলাকায় ব্রিটিশ হাই কমিশন ভবন নির্মাণের জন্য ১১ বিঘা জমি প্রদান করা হয়। একইদিনে আনসার সদর দফতর স্থাপনের জন্য ও বিআরটিসি বাস ডিপো স্থাপনের জন্য জমি প্রদান করা হয়। এছাড়া নির্বিঘœ প্রচারের স্বার্থে বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্পোরেশন ভবন নির্মাণের জন্য ১৯৭৩ সালের ২৩ জুলাই জমি বরাদ্দ প্রদান করা হয়। পর্যটন কর্পোরেশনকে ২৬ ফেব্রুয়ারি জমি বরাদ্দ প্রদান করা হয়। এছাড়া পোস্তগোলা শিল্পাঞ্চল এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য গেন্ডারিয়াতে ১৫ একর জমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন করার পরিকল্পনা নেয়া হয় বলে রজউকের দেয়া চিঠিতে তুলে ধরা হয়েছে।
এছাড়াও যেসব উদ্যোগ নেয়া হয় তা হচ্ছে, নবাবপুর থেকে ধোলাইখাল হয়ে মালিটোলা পর্যন্ত নতুন রাস্তা নির্মাণ করা, মালিবাগ অফিসার্স কোয়ার্টারের উত্তর পার্শ্বের রাস্তা নির্মাণ, এয়ারপোর্ট থেকে কাওরানবাজার বাণিজ্যিক এলাকা এবং মালিটোলা ব্রিজ থেকে আরমানিটোলা পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ ও নারায়ণগঞ্জের এলাইনমেন্ট অব বঙ্গবন্ধু রোড নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এছাড়া কাওরানবাজারের বাণিজ্যিক কর্মকান্ড সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বাণিজ্যিক এলাকার নক্সা করা হয়। মহাখালী এলাকা ও গুলশান নর্থ সার্কেল বাণিজ্যিক এলাকা, মতিঝিল ও দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার রিভাইজড লে আউট প্ল্যান ও টঙ্গী ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকার ডি ব্লকের আংশিক লে আউট প্ল্যান অনুমোদন দেয়া হয়। অপরদিকে বাদামতলীর বর্তমান পাইকারি মার্কেট নির্মাণ করা হয় ও বারিধারা এলাকায় কূটনৈতিক এলাকা বা মহল তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান সাঈদ নূর আলম জনকণ্ঠকে বলেন, ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাকে সুপরিকল্পিত দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিক বাসযোগ্য ঢাকা হিসেবে গড়তে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর আমলে গৃহীত সকল কর্মকান্ড সম্পর্কীয় জানাতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমাদের চিঠি প্রদান করা হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা এ সংক্রান্ত সকল তথ্য ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয়ে প্রদান করেছি। রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, মূলত স্বাধীনতার পরপরই নাগরিকদের স্বার্থে কাজ শুরু করেন তিনি। এ সময়ে পাইকারি মার্কেট নির্মাণ, কূটনৈতিক জোন ও নতুন রাস্তা তৈরি, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা ও মতিঝিল দিলকুশাসহ কয়েকটি বাণিজ্যিক এলাকা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। এছাড়াও তৎকালীন ডিআইটিকে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ সম্পন্ন করতে নানা দিকনির্দেশনা প্রদান করেন জাতির পিতা। যার বেশ কিছু কাজ পরবর্তীতে সম্পন্ন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারি কর্মকান্ডের সুফল বর্তমানে ভোগ করছেন নগরবাসী।