অস্তিত্বহীন ১২৫ প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স বাতিল করেছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। নামসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধায় মালামাল এনে পুনঃরফতানি না করে খোলাবাজারে বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েকশ’ কোটি টাকা। অডিটের জন্য কাস্টমস কর্মকর্তারা সরেজমিন কারখানা পরিদর্শনে গেলে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। এ ধরনের আরও ৩৬২টি প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলোর লাইসেন্স বাতিলের প্রক্রিয়া চলমান আছে। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা ও দায়দেনা নিরূপণের কাজ চলছে। আগামী ১ মাসের মধ্যে ৯২টির লাইসেন্স বাতিল করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে পাঠানো হয়েছে। এ প্রতিবেদনে রাজস্ব আদায়ের চিত্র, বন্ড লাইসেন্স সংক্রান্ত তথ্য, অডিট সম্পর্কিত তথ্য, হোম কনজাম্পশন সম্পর্কিত তথ্য, রাজস্ব বকেয়ার তথ্য, মামলা সম্পর্কিত তথ্য, প্রিভেন্টিভ কার্যক্রম, সংস্কার কার্যক্রমসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়। এছাড়া বন্ড অপব্যবহার বন্ধে ৪ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে এক্সপোর্ট জেনারেল মেনিফেস্টো চালু করা; ইপিজেডগুলোতে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম পূর্ণাঙ্গরূপে চালু করা; বিজিএমইএ’র দেয়া ইউডির (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন) সংশোধনী অনলাইনে প্রেরণের বাধ্যবাধ্যতা আরোপ এবং বন্ড কমিশনারেটকে ভেঙে অঞ্চলভিত্তিক ২টি বন্ড কমিশনারেট প্রতিষ্ঠা করা।
জানতে চাইলে বন্ড কমিশনারেটের কমিশনার শওকত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বন্ড ফাঁকিবাজদের কোনো প্রকার ছাড় নেই। যারা এ অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত আছে, তারা যত শক্তিশালীই হোক না কেন, প্রমাণ পেলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কর্মকর্তাদের অডিট নবায়নের জন্য সব প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া গোপন তথ্যের ভিত্তিতেও অভিযান চালানো হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বন্ড অপব্যবহার বন্ধের পাশাপাশি বকেয়া পাওনা আদায়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব না দিতে গড়িমসি করছে। অনেকে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। এসব মামলা শুনানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঢাকা বন্ড কমিশনারেটের আওতায় সাড়ে ৬ হাজারের বেশি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ৭০ ভাগের বেশি চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত। মূলত দুইভাবে বন্ডের পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রথমত, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বন্ড লাইসেন্স খুলে পণ্য আমদানি করে। দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কাঁচামাল শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করে। আমদানি প্রাপ্যতা নির্ধারণ পদ্ধতির দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই এ কাজটি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা। অনেক প্রতিষ্ঠানের রফতানি আদেশ যৎসামান্য থাকলেও কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে শুধু মেশিনের উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী প্রাপ্যতা নির্ধারণ করিয়ে নিচ্ছে। এভাবে আমদানি করা অতিরিক্ত কাঁচামাল তারা খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে।
অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই কালোবাজারে শুল্কমুক্ত পণ্য বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এ চক্রটি বন্ডের কাপড় চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে খালাস হয়ে ঢাকার আশপাশের পাইকারি বাজারে নিয়ে যায়। রাতের আঁধারে নারায়ণগঞ্জের সানারপাড়, চিটাগাং রোড, কাঁচপুর এলাকায় কাপড়বোঝাই গাড়ি আনলোড হয়। এজন্য চিটাগাং রোডের অনেক বাসা-বাড়িতে অস্থায়ী গোডাউনও গড়ে উঠেছে। এসব গোপন গোডাউন থেকে সুবিধামতো সময়ে কাপড় হাতবদল হয়। নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে সুতা, পুরান ঢাকার ইসলামপুরে বন্ডের কাপড়, নয়াবাজারে কাগজ ও উর্দু রোডে পিপি দানা বিক্রি হয়। মাঝেমধ্যে দু-একটি চালান বন্ড কর্মকর্তাদের অভিযানে ধরা পড়লেও বেশির ভাগই আড়ালে থেকে যাচ্ছে।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী বলছেন, বন্ডের লাইসেন্স প্রক্রিয়ার গোড়ায় গলদ রয়েছে। সৎ ব্যবসায়ীরা লাইসেন্স চেয়েও পায় না। লাইসেন্স পেতে ক্ষেত্রবিশেষে কারও দুই মাস লাগে। আবার কারও কয়েক বছর লাগে। এটা নির্ভর করে কর্মকর্তাদের কে কীভাবে ম্যানেজ করছে তার ওপর। অসৎ ব্যবসায়ীদের একটি লাইসেন্স বন্ধ করলে কয়েকদিন পরই অন্য নামে লাইসেন্স নিয়ে আবারও ব্যবসা শুরু করেন। সব গলদ লাইসেন্স প্রক্রিয়াতেই। লাইসেন্স অনুমোদনের জন্য কয়েকটি বিষয়ে দেখা হয়। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সরেজমিন কারখানা পরিদর্শন। এই রিপোর্টের ভিত্তিতেই লাইসেন্স দেয়া হয়। সরেজমিন প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, যন্ত্রাংশ, কাঁচামালের ব্যবহার ইত্যাদি বিষয় যাচাই-বাছাই করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে লাইসেন্স দেয়া হয়। এই রিপোর্ট যারা দেন, তারা অনেক সময় টাকার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানে সরেজমিন না গিয়ে রিপোর্ট জমা দেন। আর গেলেও নামকাওয়াস্তে পরিদর্শন করে ব্যবসায়ীদের চাহিদার ভিত্তিতে রিপোর্ট জমা দেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন যুগান্তরকে বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি সেগুলোর আমদানির তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করা উচিত। এসব প্রতিষ্ঠান কবে বন্ধ হয়েছে, বন্ধ হওয়ার পর কাঁচামাল আমদানি করেছে কিনা, নাকি শুধু কাগজে-কলমে কারখানা খুলে বন্ডের আওতায় মালামাল আমদানি করেছে- সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনা করে যদি দেখা যায় কারখানা বন্ধ থাকার পরও মালামাল আমদানি হয়েছে। তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শুল্ক ফাঁকির পাশাপাশি ফৌজদারি আইনে মামলা করা উচিত। আর যদি কাগজে-কলমে কারখানা হয়, তাহলে ওই কারখানার লাইসেন্স দেয়ার সময় কমিটিতে যেসব কর্মকর্তা ছিলেন বা যাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
বন্ড কমিশনারেটের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বর্তমানে এই কমিশনারেটের আওতায় ৬ হাজার ৬৮৪টি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের রয়েছে। এর মধ্যে নানা অনিয়মে জড়িত থাকায় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ২ হাজার ৫০৩টির লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। সর্বমোট ৩ হাজার ৬৪০টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত রয়েছে। স্থগিত থাকা ৩৬২টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের হালনাগাদ নিরীক্ষা ও দায়দেনা নিরূপণের কাজ চলছে। আগামী ১ মাসের মধ্যে ৯২টি লাইসেন্স বাতিল করার কার্যক্রম সম্পন্ন হবে। ৩ বছরের বেশি সময় অডিট করেনি ৭১৪টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা নিবন্ধন নম্বর (বিআইএন) লক করা হয়েছে।রাজস্ব আদায় কার্যক্রম তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত বন্ড কমিশনারেট রাজস্ব আদায় করেছে এক হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ৯৫১ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর মাসওয়ারি ভিত্তিতে অক্টোবরে আদায় হয়েছে ৩৯৫ কোটি টাকা। অক্টোবরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৭৮ কোটি টাকা।
মামলা সম্পর্কিত তথ্যে বলা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগ, আপিলাত ট্রাইব্যুনাল ও সার্টিফিকেট মামলা রয়েছে ৪৫৬টি। এসব মামলায় জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ২ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে রাজস্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৩০টি মামলা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব মামলায় এক হাজার ৩৫৭ কোটি টাকার রাজস্ব জড়িত। এগুলো আদালতের অনুমতিক্রমে কজলিস্টে অন্তর্ভুক্ত শুনানির উদ্যোগ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে পাঠানো হয়েছে। সার্টিফিকেট মামলা নিয়মিতভাবে তদারকির মাধ্যমে নিষ্পত্তি কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা হচ্ছে।