অর্থ পাচারের ওপর বসছে শুল্ক-ভ্যাট

admin
নভেম্বর ২১, ২০২০ ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

বাণিজ্যের আড়ালে আন্ডার ইনভয়েসিং বা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে ৮০ শতাংশ অর্থ পাচার হয়। তাই পাচার করা অর্থের ওপর পরোক্ষ কর (শুল্ক ও ভ্যাট) আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ জন্য কাস্টমস ও ভ্যাট আইন সংশোধনসহ বিদেশি রাজস্ব আদায়কারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। বর্তমানে পাচারকৃত অর্থের ওপর জরিমানাসহ শুধু আয়কর আদায়ের বিধান রয়েছে।

সূত্র জানায়, গত ২৮ জুলাই বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তা আবু হেনা মো. রাজী হাসানের নেতৃত্বে একটি ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে দুদক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সিআইডি, এনবিআর ও শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিনিধি অংশ নেন। সভায় মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়। এতে পাচার করা অর্থ বা সম্পদের ওপর ট্যাক্স রিকভারি বা কর আদায়ের কর্মকৌশল নিয়ে আলোচনা হয়।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে পাচারকৃত অর্থের ওপর প্রত্যক্ষ কর বা আয়করের পাশাপাশি পরোক্ষ কর (শুল্ক ও ভ্যাট) আদায়ের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। চিঠিতে বলা হয়: যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পরোক্ষ কর ফাঁকির মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছে তা ফেরত আনার বিষয়েও উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি শুল্ক ও ভ্যাট আদায় করা যেতে পারে। যেসব প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতায় নিবন্ধিত তাদের ক্ষেত্রে প্রকৃত বিক্রয় প্রদর্শন না করে অর্থ পাচারের সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় এনবিআরের তদন্তাধীন অধিকাংশ মামলাই শুল্ক সংক্রান্ত অপরাধ। মূলত আমদানি বা রফতানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে থাকে। এগুলোর বিপরীতে ভ্যাট বা শুল্ক কিংবা দুটোই ফাঁকি দেয়া হয়েছে। তা ফেরত আনার বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের কাস্টমস বিভাগের সঙ্গে এনবিআর পারস্পরিক সমঝোতা চুক্তি করে থাকে। এসব চুক্তিতে অবৈধভাবে পাচার হওয়া অর্থের ওপর পরোক্ষ কর আদায়ের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ভ্যাটের ক্ষেত্রে অনুরূপভাবে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থের ওপর ভ্যাট আদায়ের সম্ভাবনা যাচাই করা যেতে পারে।

এনবিআর সূত্র জানায়, শুল্ক গোয়েন্দার প্রস্তাব পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পাচারকৃত অর্থের ওপর পরোক্ষ কর আদায়ের কর্মকৌশল নির্ধারণে এনবিআরের জ্যেষ্ঠ সদস্যের নেতৃত্বে একটি সভা ঢাকা হয়েছিল। কিন্তু ওই কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় সভা হয়নি। সূত্র জানায়, শিগগির পরোক্ষ কর আদায়ের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে বৈঠক করা হবে। পাচারকৃত অর্থের ওপর পরোক্ষ কর আদায়ে ভ্যাট ও কাস্টমস আইন সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যমতে, বাণিজ্যের আড়ালে ওভার ইনভয়েসিং (আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো) এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (রফতানিতে মূল্য কম দেখানো) মাধ্যমে ৮০ শতাংশ অর্থ পাচার হয়ে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিবছর বাংলাদেশের যে বাণিজ্য (আমদানি-রফতানি) হচ্ছে, তার ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ অর্থই বিদেশে পাচার হচ্ছে। দেশ থেকে যেসব টাকা পাচার হয়, তার বড় অংশই যায় উন্নত ৩৬ দেশে। এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ৪৬০ কোটি ডলার।

শুল্ক গোয়েন্দার ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ অভিবাসন বা স্কিমের আওতায় কানাডা, দুবাই, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ব্যবসা, বাড়ি, গাড়ি বা অন্য সম্পদ ক্রয়ে বিনিয়োগ হচ্ছে। এসব টাকা ওই দেশের ব্যাংকেও জমা হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ পাচার হয়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন দেশের মূলধন কমে গিয়ে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ উৎপাদন ও কর্মসংস্থান ব্যাহত হচ্ছে, অপরদিকে পাচার করা অর্থের সিংহভাগই করদাতার আয়কর নথিতে অপ্রদর্শিত এবং কর আদায় করা যাচ্ছে না। ফলে রাজস্ব হারানোর মাধ্যমেও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাচারকৃত অর্থ সম্পদের ওপর উন্নত দেশগুলো ট্যাক্স রিকভারি পদ্ধতি অনুসরণ করছে, বাংলাদেশও তা করতে পারে।

এদিকে চিঠিতে পাচার করা অর্থের তথ্য সংগ্রহের জন্য বিদেশি কাস্টমস ও ভ্যাট এজেন্সির সঙ্গে পারস্পরিক সহায়তা বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশি মিশনগুলোয় স্থায়ীভাবে পরোক্ষ কর কর্মকর্তাদের জন্য সেল গঠন করে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়।

প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছরের বাজেটে আয়কর অধ্যাদেশে পাচারকৃত অর্থের ওপর কর আদায়ের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। নতুন বিধান অনুযায়ী, কোনো করদাতার দাখিলকৃত আয়কর বিবরণীতে আমদানি-রফতানি প্রদর্শন করলে গৃহীত বা পরিশোধিত অর্থের সঙ্গে প্রকৃত লেনদেনের পার্থক্য থাকলে ওই পার্থক্যের ওপর ৫০ শতাংশ কর আদায় করা হবে। একইভাবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিবরণীতে প্রদর্শিত ও প্রকৃত বিনিয়োগের পার্থক্য থাকলে পার্থক্যের ওপর ৫০ শতাংশ কর আদায় করা হবে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ওভার ইনভয়েসিং বা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে যেহেতু বেশি অর্থ পাচার হয়, সেহেতু পরোক্ষ কর আদায় করা যেতে পারে। এ জন্য বিদ্যমান আইনকানুন সংশোধনের প্রয়োজন হলে সরকার সেটা করতে পারে। সামগ্রিকভাবে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা বা কর আদায়ের জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন প্রয়োজন। যার কাজ হবে শুধু অর্থ পাচার প্রতিরোধে কাজ করা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৫-৬ বিলিয়ন ডলার পাচারের যে খবর আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলো প্রকাশ করে, তার ৮০ ভাগই বাণিজ্যের আড়ালে হয়। সে দিক থেকে পাচারকৃত অর্থের ওপর পরোক্ষ কর আরোপে শুল্ক গোয়েন্দা যে সুপারিশ করেছে তা ঠিক আছে। তবে মানি লন্ডারিং আইনে অর্থ পাচার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ক্ষেত্রে পাচারকৃত অর্থের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আদায় করে পাচারকারীকে ছাড় দেয়া হবে, নাকি পাচারের দায়ে শাস্তি পেতে হবে, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে অর্থ পাচার রোধে যত আইন দেশে রয়েছে, সেগুলো রিভিউ করা যেতে পারে এবং সমন্বিত আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে।